Image description
র‍্যাবের ক্ষমা প্রার্থনা কি বাহিনীটিকে বিতর্ক মুক্ত করতে পারবে?
আয়নাঘর, গুম-খুনের অভিযোগে ক্ষমা চেয়েছেন র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান। কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক মতবিনিময় সভায় বৃহস্পতিবার দুঃখপ্রকাশ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি। র‍্যাব দ্বারা যারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত হয়েছেন এবং নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ যারা র‍্যাবের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চান তিনি। এর আগে জুলাই আন্দোলনে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে পুলিশের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়েছিল। সেই আন্দোলন চলার সময় র‍্যাবের হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করার অভিযোগ উঠেছিল। এবার র‍্যাবের পক্ষ থেকে এমন সময়ে ক্ষমা চাওয়া হলো যখন ক্রমাগত বাহিনীটির বিলুপ্তির দাবি উঠছে। র‍্যাব প্রধানের এই ক্ষমা প্রার্থনা কি বাহিনীকে বিতর্ক থেকে মুক্তি দিতে পারবে? বিএনপির র‍্যাব বিলুপ্তির দাবি ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ ম্যালেরিয়া জ্বরের ওষুধের ভয়ানক তেতো স্বাদ নিয়ে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর এই বাক্য র‍্যাবের ক্ষেত্রে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণই বলছেন অনেকে। র‍্যাবকে অতীতে অনেক বিশ্লেষক ও বিরোধী নেতারা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের গল্পের সাথেও তুলনা করেছিলেন। লাশে প্রাণ এনে অতিমানব সৃষ্টি করে তার দানবে রূপান্তর হওয়ার গল্প ছিল ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের। এগুলোর সাথে মিল খোঁজা হচ্ছে কারণ, পুলিশ যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিল না, এমন এক পরিস্থিতিতে ২০০৪ সালে বিকল্প একটি বাহিনী হিসাবে ‘র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন’ বা র‍্যাব কার্যক্রম শুরু করেছিল। তবে পরে তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনসহ নানা রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে বাহিনীটির কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপি শাসনামলে গঠন হওয়া সেই বাহিনীর বিলুপ্তির কথা বলছে এখন খোদ বিএনপিই। ‘দেশে তো র‍্যাব মানেই একটা দানব সৃষ্টি করেছে তারা। তারা যত ধরনের খুন-গুম, যত এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং (বিচারবহির্ভূত হত্যা), অধিকাংশই এই র‍্যাবের মাধ্যমে হয়েছে,’ বলেছেন বিএনপির গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিটির প্রধান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ। সেজন্য র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছেন বলে জানান তিনি। তবে বিএনপির এই দাবি নিয়ে র‍্যাবের মহাপরিচালকের কাছেও সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল। তিনি বলেছেন, ‘দেশের জনগণ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে র‍্যাবের ব্যাপারে রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব।’ গুম, খুন, অপহরণ এসব অভিযোগ বিবেচনায় ক্ষমা চেয়ে সেসব ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার প্রত্যাশা করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের গুম-খুন কমিশন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ ধরনের অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার কাজের মধ্য দিয়েই র‍্যাবের দায়মুক্তি সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। যেভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠল র‍্যাব বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঠেকাতে ২০০২ সালের অক্টোবরে মধ্যরাতে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ করে সারাদেশে একযোগে অভিযান শুরু করেছিল সেনাবাহিনী। আলোচিত সমালোচিত সে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ সমাপ্তির পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা থেকে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ যাত্রা শুরু হয় চৌকস বাহিনী র‍্যাবের। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ কার্যক্রম কমে আসা এবং ‘ক্রসফায়ারের’ নামে সন্ত্রাসীদের দমন প্রথমদিকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে সেই ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ নিয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যানুসারে, বিএনপি শাসনামলে ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে প্রায় ৩৮০ জন নিহত হয়। র‍্যাবের কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ, চাঁদাবাজি, ডাকাতির মতো অভিযোগ ২০০৫ সালে তোলা হয়েছিল মার্কিন তারবার্তায়। বিভিন্ন সময় বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক হলেও মূলত দু’টি ঘটনা র‍্যাবকে বড় বিতর্কের মুখে ফেলে দেয়। একটি ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র‍্যাবের সম্পৃক্ততা। অন্যটি ২০১৮ সালে টেকনাফের একরামুল হক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্রসফায়ারের অডিও ফাঁস। এছাড়াও অর্থের বিনিময়ে ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তুলে নেয়া, ঘুষ, চাঁদাবাজি এমন বিভিন্ন অপরাধমূলক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন আসতেই থাকে। তবে বড় একটা ধাক্কা আসে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যখন ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগে র‍্যাব এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এই নিষেধাজ্ঞার পর থেকে র‍্যাবের ক্রসফায়ার অনেকটাই কমে যায়। তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় যারা কাজ করছে, তাদের ওপর এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র‍্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সালে থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয় শ’টির মতো বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ছয় শ’জনেও বেশি মানুষের গুম হয়ে যাওয়া এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী। অন্যদিকে সরকারের গুম সংক্রান্ত যে কমিশন গঠন হয়েছে, তাদের একটি সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ শ’র বেশি অভিযোগ পেয়েছেন তারা। এর মাঝে চার শ’ অভিযোগ খতিয়ে সর্বোচ্চ ১৭২টি অভিযোগ পাওয়া গেছে র‍্যাবের বিরুদ্ধে। গুম সংক্রান্ত অভিযোগ জবাবদিহিতার কাজও শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করেন কমিশনের সভাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। বৃহস্পতিবার র‍্যাবের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, ‘গুমের অভিযোগ এবং আয়নাঘরের বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযোগগুলোর সত্য উদঘাটনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ র‍্যাব বিলুপ্তি না কি সংস্কার? বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হলেও সম্পূর্ণ বাহিনীকে বিলুপ্ত করার প্রশ্নে দ্বিমত রয়েছে বিশ্লেষকদের। যেখানে বাহিনী সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সেখানে ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে বা শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা বিলুপ্ত করার জন্য ‘খুব সঙ্গত কারণ না’ বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুযায়ী, নাগরিক স্বাধীনতা বা অধিকারের জায়গা অক্ষুণ্ণ রেখে বাহিনীর ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই বাহিনীটিকে কার্যকর করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। একই ধরনের মত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদা আক্তারেরও। ‘বিশেষায়িত বাহিনী র‍্যাব কিংবা অন্য যেকোনো বাহিনী বিলুপ্ত করার চেয়ে সবচেয়ে জরুরি এর সংস্কার করা’ বলছিলেন তিনি। মাহমুদা আক্তারের মতে, অনেকে বিলুপ্তিকেই সমাধান মনে করলেও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা খুব কার্যকর না। বরং যেসব অভিযোগ এসেছে, সেসব যাতে আর না ঘটে এবং যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাহিনী গঠন করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্য সাধনে বাধার জায়গা চিহ্নিত করে গঠনগত পরিবর্তন, প্রশিক্ষণ, সেবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাটা বেশি জরুরি বলে মনে করেন তিনি। পুলিশ বা সামরিক বাহিনী আলাদাভাবে কাজ করলেও এমন বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা থাকে বলে মনে করেন অনেকে। যেমন নুরুল হুদার মতে, বিশ্বের অনেক দেশেই এমন আলাদা চৌকস বাহিনী থাকে এবং অন্যান্য বাহিনীর নিজস্ব রুটিন কার্যক্রম থাকে। অস্ত্র নিয়ে মোকাবিলা করার মতো প্রয়োজনে, আইনানুগভাবে ‘তদন্ত ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ’ করার মতো কাজে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগের জায়গায় র‍্যাবের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি। কাজ কী কৌশলে করা হবে সেটা নিয়ে রাজনীতিবিদদের পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ, বাহিনী যারা চালান তাদের দিকনির্দেশনার জায়গা এবং আইন অনুযায়ী সঠিকভাবে অভিযান পরিচালনা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেন নুরুল হুদা। র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, গুম-খুন, আয়নাঘর, জুলাই অভ্যুত্থানে গুলিবর্ষণ এবং ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া নিয়ে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন বর্তমান মহাপরিচালককে। ‘র‍্যাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করা হয় এবং প্রমাণিত হলে কঠোর বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। র‍্যাব ডিজি উদাহরণ দেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত র‍্যাব ফোর্সেসের ৫৮ জন কর্মকর্তাসহ চার হাজার ২৩৫ জন সদস্যকে শৃঙ্খলা বহির্ভূত কার্যক্রমের জন্য লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি র‍্যাব সদর দফতরসহ কয়েকটি ব্যাটালিয়নের ১৬ জন সদস্যকে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতির অভিযোগে আটক করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেন তিনি। ‘জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য সংস্থা ও স্টেক হোল্ডারদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে র‍্যাব সদস্যদের মানবাধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ’ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার ইস্যুসহ যেসব বিষয়ে র‍্যাব বিতর্কিত হয়ে উঠেছে, সেখান থেকে সার্বিকভাবে বাহিনীটি কতটা আস্থা ফেরাতে পারবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। সূত্র : বিবিসি