কুয়াশার চাদরে মোড়া শীতের সকাল। সাড়ে আটটার দিকে মিষ্টি রোদে চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিলেন আফজাল হোসেন। ৯টায় আসবে এক গাড়ি বালু। তিনি মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বাস্তা এলাকার বাসিন্দা। তার পৈতৃক জায়গা ছিল না নিজ দখলে। বছরের পর বছর ছিল মানিকগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের লোকজনের দখলে। ছেলে থাকেন সৌদি আরবে। ২৪’র নির্বাচনে মমতাজকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রপ্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু আসার পরও দখলে নিতে পারেননি। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরই পালিয়ে যায় এলাকার দখলদার নেতারা। এরপরই দ্রুততার সঙ্গে বাড়ির কাজে হাত দেন। তিনি বলেন, ‘রাস্তার পাশের বাপ-দাদার জমি। তারপরও বছরের পর বছর জমিতে যাইতে পারি নাই। এখন নিজের জমির দখল পাইছি। বলেন, এলাকায় এখন শান্তিতে আছি। নিজের জায়গায় বাড়ি করতেছি কেউ বাধা দেবার নাই।’
সিংগাইর উপজেলা। কৃষি ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ মূল আয় এই এলাকার। সরকারি হিসাবে এক লাখ ১৮ হাজার প্রবাসী এই উপজেলায়। মানিকগঞ্জ জেলার বাসিন্দারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিশেষ করে মমতাজের লোকেদের রক্তচক্ষুতে আড়ষ্ট ছিল। এখন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে বিএনপি। তবে এলাকাবাসী বলছেন, ভালো আছেন তারা। নেই ভয়। শহরজুড়ে প্রভাব ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি আফরোজা খান রিতা। তার এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছে বিএনপি। আর পতিত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা রয়েছেন লুকিয়ে, নিজেকে বাঁচিয়ে।
বাস্তা এলাকার সেই চায়ের দোকানে সকালের আড্ডায় বসেছিলেন প্রায় সাত থেকে আটজন। দেশের বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে। তাদের মূল কথা এলাকায় শান্তি আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে সন্তুষ্ট তারা। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতিতে উৎকণ্ঠা, বিরক্ত। এছাড়াও এলাকায় মাদকের বিস্তার নিয়েও চিন্তিত।
বাজারের একটি ফার্মেসি দোকানের স্বত্বাধীকারী মিজানুর রহমান বলেন, দেশে আওয়ামী লীগের শাসন দেখেছি, বিএনপি’র শাসনও দেখেছি। সুযোগ পেলে সবারই একই চিন্তা। এখন দেশের মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন আনা দরকার। নির্বাচন হলে কী হবে? আবারও একই তরকারি হবে। হয়তো লবণ, ঝাল কম বেশি হবে। কিন্তু আমরা চাই তরকারিটারই পরিবর্তন হোক। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের জন্য অনেক করেছে। তাদের এখন রাজনীতি নিয়ে কম কথা বলা উচিত। এতে তাদের প্রতি দেশের মানুষের আস্থার জায়গাটা অটুট থাকবে।
বয়স প্রায় ৭০। নিরঞ্জন চন্দ্র রায় বলেন, আমরা সব সময়ই দেশে ভয়ে থাকি। আমাদের এলাকায় একটা ছোট হিন্দুপাড়া আছে। এই এলাকায় কোনো আক্রমণ বা হামলা হয় নাই। কিন্তু সবসময় একটা ভয় কাজ করে। কারণ আমাদের নিয়ে রাজনীতি করা সহজ। তিনি বলেন, আমাদের চাওয়া অল্প আওয়ামী লীগের আমলেও বাজারে গিয়ে শান্তি পাই নাই। এখনো পাচ্ছি না। ইউনূস সরকারের জরুরি ভিত্তিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আর যে সরকরাই আসুক হিন্দুদের নিয়ে যাতে রাজনীতি করা না হয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যারা অপরাধী তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু ভোটে দুই দল থাকলে ভালো হয়।
বাস্তা থেকে এগিয়ে সুতক্ষীরা এলাকায় দেখা যায় রাস্তার পাশে লাউ বিক্রি করছিলেন আম্বিয়া আক্তার। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া এই নারী বলেন, দেশ নিয়ে ভাববো বড়লোক মানুষ। আমি ভাবলে কী হইবো? এখন আমার কথা এই ছয়টা লাউ বেইচা আমি চাল-ডাল কিনুম। তিনি লাউ বিক্রি করছিলেন ৪০ টাকায়। ৬টি লাউ নিয়ে বসেছেন। বলেন, এই লাউ আমি মাসের পর মাস ধইরা বড় করছি। ছয়টা লাউ বেইচা আমার ছয় কেজি চাল কিনবার চাই। কিন্তু পারি না।
জামির্তা বাজারেও সকালের নাস্তার জন্য বাড়ছে ভিড়। চায়ের দোকানগুলোতে রীতিমতো উপচেপড়া ভিড়। ষাটোর্র্ধ্ব হাজী আবদুস সাত্তারও পায়ের উপর পা তুলে ধোঁয়া ফুঁকছিলেন। বলেন, সব ভালোর পরও কিছু বিষয় থেকে যায়। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিস্থিতি ভালো না। ছিঁচকাচুরি বেড়েছে।
এই বাজারে কথা হয় বেশ কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে। রিতা, সাবরিনা ও মালতি বলেন, আমাদের কথা কেউ ভাবে না। আমরা কোনো আমলেই কোনো সহযোগিতা পাই না। আমরা খাই মানুষের কাছে হাত পেতে। আমরা অসহায় কিন্তু এরপরও আমাদের কাছে ব্রিজে টাকা নিতো। ব্রিজের পোলাপান আজে বাজে কথা কইতো। এখন ভালো আছি ব্রিজে ট্যাকাও তোলে না। আমাগোরে আর ভয়ও লাগে না।
নীরব রাস্তা ধরে এগুলে পথিমধ্যে পড়ে মানিকনগর বাজার। বুধবার ছিল বাজারটির হাটবার। কবুতরের হাটে ব্যাপক ভিড়। মো. আলিম বলেন, আগে কবুতর আনলেই খাঁচাপ্রতি ৪০ টাকা দেয়া লাগতো। এখন লাগে না। এমনও দিন গেছে, একটা কবুতরও বিক্রি হয় নাই খাঁচার খরচ দেয়া লাগছে। এখন কেউ চাঁদা নেয় না। শান্তিতে আছি। একই কথা বলেন- এই বাজারের সিএনজি অটোরিকশাচালক মো. রুবেল। বলেন, একবার গাড়ি সিরিয়ালে দিলে আগে দিনে ১৬০ টাকা আর মাসে দেয়া লাগতো ৩০০ টাকা। এখন এই ঝামেলা নাই, যে আগে আসে সেই সিরিয়াল দিতে পারে।
তবে এই বাজারে বেশ কয়েকজন বলেন- সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। কাপড় ব্যবসায়ী সাবেত আলী বলেন, আগে দিনে ১০/১২ জন ভিক্ষুক আসতো। হাটের দিন আসতো ২৫/৩০ জন। কিন্তু এখন এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আবার তার মতে, এখন বিভিন্ন এলাকা থেকেও আসা শুরু করেছে ভিক্ষুক। চোখে কম দেখেন সবুরি বেগম। ছেলে- মেয়ে নেই। ভিক্ষা করেই চলে সংসার। তিনি জানান, আগে এলাকায় বাইরের ভিক্ষুক কম দেখতেন। হাটবারের দিন অল্পকিছু এলেও অন্যান্য সময় দেখা যায় না। কিন্তু এখন দেখি আশপাশের জেলা থেকেও ভিক্ষুক আসছে।
এসব এলাকার বাইরেও হাতনি, ঋষিবাড়ী, বকচর, বিন্নাডাঙ্গী ও জায়গীর এলাকার বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা হয়। বুধবার সারা দিনে মোট ৩২ জনকে প্রশ্ন করা হয় কবে নাগাদ নির্বাচন হলে ভালো হয়। ৫ জন বলেন, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। প্রয়োজনে এই বছরেই। ১৪ জন বলেন ২০২৫ সালে। এই ১৪ জনের মধ্যে চারজন বলেন, প্রথম ৬ মাসের মধ্যে। আর বাকিরা বলেন, বছরের শেষের দিকে। ৬ জন বলেন, ২ বছর পর। ৫ জন বলেন, নির্বাচন হওয়া উচিত আরও ৩/৪ বছর পর। আর ২ জন বলেন, এটা নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর। যেটা বোঝা যাবে আরও কয়েক মাস পর। তাদের চাওয়া আগে আওয়ামী লীগের বিচার- এরপর নির্বাচন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন