
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে আদালতের কাছে স্বীকার করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের সরাসরি হস্তক্ষেপে দিনের ভোট রাতে করাসহ নানা অনিয়ম হয়েছে। তখন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরো নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল বলে তিনি পরে বুঝতে পারেন।
একাদশ জাতীয় সংসদের ভোট হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ওই নির্বাচনের পরপরই দিনের ভোট রাতে করার বিষয়টি দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। প্রায় সাত বছর পর নির্বাচনের সেই অনিয়মের বিষয়টি তৎকালীন সিইসি নিজে আদালতের কাছে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে তুলে ধরেছেন। জবানবন্দিতে তাঁর এই বক্তব্য সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সাবেক সিইসি নূরুল হুদা গত মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি রেকর্ড করেন সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল সিএমএম মো. জিয়াদুর রহমান।
দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগে বিএনপির এক নেতার করা রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় গত ২২ জুন গ্রেপ্তার হন নূরুল হুদা। গ্রেপ্তারের পরদিন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতকে বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। সেই বিতর্কের দায় নির্বাচন কমিশনের নয়। এরপর দুই দফায় তাঁকে আট দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন সাবেক আরেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।
৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন বিএনপির পক্ষ থেকে লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ জানানো হয়েছিল, ‘অন্তত দেড় শ আসনে ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি রাখা হয়েছে।’ ভোটের পরদিন ৩১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অসত্য কথা। এই নির্বাচনে কমিশন পুরোপুরি সন্তুষ্ট।’
নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তৎকালীন এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা
নূরুল হুদা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, দলের নেতা-কর্মী, নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।
জবানবন্দিতে সাবেক সিইসি বলেন, ‘আমি মনে করি, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা করে প্রশাসন ও পুলিশের কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি করে দিনের ভোট রাতে গ্রহণ করেছে এবং অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় শতভাগ ভোট গ্রহণ দেখানো হয়েছে, যা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
তৎকালীন সরকারি দলের সরাসরি হস্তক্ষেপেই অনিয়মগুলো সংঘটিত হয়েছে উল্লেখ করে নূরুল হুদা বলেন, ‘কিছু কিছু অতি উৎসাহী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনী অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন বলে আমি মনে করি।’
সাবেক সিইসি ২০১৮ সালের ভোটের অস্বাভাবিক ফলাফলের তথ্যও উল্লেখ করেছেন জবানবন্দিতে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমি রেজাল্ট শিট দেখে জানতে পারি যে অনেক কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়ে, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আরও শুনেছি যে অনেক কেন্দ্রে রাতে ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপার ভর্তি করা হয়। রাতেই ভোট দেওয়া হয়ে যায়।’
এই কাজে কারা জড়িত ছিলেন, সেটাও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন নূরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবে তাদের কর্মী বাহিনী, দায়িত্বে থাকা পুলিশ, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এই কাণ্ড ঘটেছে বলে আমি মনে করি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এ ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। আমি বিশ্বাস করি, আমি বা আমার কমিশনের লোকদের অন্ধকারে রেখে এই অরাজক পরিস্থিতি ও ভোটের অনিয়ম করা হয়েছিল।’

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার তৎকালীন কর্মকর্তাদের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন নূরুল হুদা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল বলে আমি পরে বুঝতে পারি। নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে আমি বিশ্বাস করি যে নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়ম হয়েছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় ভোট গ্রহণ হয়েছে, যা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
ডিজিএফআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং এনএসআই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পরিচালিত পৃথক দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন। আর এনএসআইয়ের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জুবায়ের। তাঁদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। তাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ হয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের দুজনের বিদেশযাত্রাও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
জবানবন্দিতে আসা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাইফুল আবেদিন ও টি এম জুবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
জড়িত ছিলেন পুলিশ সদস্যরা
দিনের ভোট রাতে করার ক্ষেত্রে পুলিশের অনেক সদস্য জড়িত ছিলেন বলে জবানবন্দিতে বলেন নূরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে কর্মরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও আমাকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করে নাই। তারা আমাকে প্রকৃত ঘটনা জানায় নাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আগের দিন রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি করে দেয় বলে শুনেছি। নির্বাচনের পূর্বে পুলিশ গণহারে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছিল বলে আমি অভিযোগপ্রাপ্ত হই। এ বিষয়ে আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা জানান, ওই সব লোকের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।’ এ জন্য তিনি কিছুই করতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন।
নূরুল হুদা জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি বা আমার কমিশনের লোকদের অন্ধকারে রেখে এই অরাজক পরিস্থিতি ও ভোটের অনিয়ম করা হয়েছিল। এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট বিব্রত ছিলাম। যেহেতু গেজেট প্রকাশের পর আমাদের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা থাকে না, তাই আমি নির্বাচন বাতিল করতে পারি নাই।’
নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু ওই সব কর্মকর্তা তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনকে অন্ধকারে রেখে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির সুযোগ সৃষ্টি করেছেন বলে আমি মনে করি।’

অভিযোগ না পাওয়ার বিষয়ে নূরুল হুদা বলেন, ‘২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিনের ভোট রাতে হয়েছে, এ বিষয়ে আমার কাছে সরাসরি কোনো অভিযোগ না আসার কারণ দুটি হতে পারে। প্রথমত, আমার অজ্ঞাতে টাকা নিয়ে নির্বাচনী ফিল্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে মুখ বন্ধ করা হতে পারে। তা ছাড়া আনসার, স্কুলশিক্ষকসহ অনেক কর্মচারী রাজনৈতিক দলের প্রভাবে চাকরিতে ক্ষতি হওয়ার ভয়ে চেপে যায়। তবে যারা ক্ষমতায় ছিল এবং পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, সেসব বেনিফিশিয়ারিকে (সুবিধাভোগী) সেন্ট্রালি অর্গানাইজড (কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত করা) করে টাকা বিতরণ এবং দিনের ভোট রাতে করেছে বলে মর্মে আমার বিশ্বাস। কারণ, তারা তখন রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় ছিল।’
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। গণ–অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি কারাগারে রয়েছেন। তাঁর ভূমিকার বিষয়ে নূরুল হুদা বলেন, ‘আমার কাছে তাঁর ভূমিকা সন্দেহজনক মনে হয়েছে। কারণ, যেহেতু তিনি প্রশাসন ক্যাডারের লোক, তাঁর পক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব ছিল।’
নির্বাচন শতভাগ নিরপেক্ষ করতে চাইলে সরকারের সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে নূরুল হুদা বলেন, ‘সরকারি দলের প্ররোচনায় এবং হস্তক্ষেপেই সুষ্ঠু (নির্বাচন) করা সম্ভব হয় না। সেই পরিস্থিতিতে অতি উৎসাহী কিছু সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী নির্বাচনী অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন বলে আমার বিশ্বাস।’
নূরুল হুদা তাঁর ভাগনে এস এম শাহজাদার আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার বিষয়েও আদালতকে জানিয়েছেন। নূরুল হুদা জবানবন্দিতে বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে আমার ভাগিনা (এস এম শাহজাদা) পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে এমপি প্রার্থী হয়। সে ক্ষমতাসীন দলের প্রতীকে নির্বাচন করেছে। তার নির্বাচনের মনোনয়ন পেতে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সে পূর্ব থেকে স্থানীয়ভাবে রাজনীতি করত। তবে কোনো পদপদবি তার ছিল না। তবে আমার ভাগিনা হিসেবে সে কিছু প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হয়।’
আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য
দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগের বিষয়ে নূরুল হুদার আইনজীবী ওবায়দুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হয়রানি করার জন্য আমার মক্কেল নূরুল হুদাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জবানবন্দিতে তিনি নিজেকে জড়িয়ে কিছু বলেছেন কি না, সেই তথ্য আমরা জানি না।’
অন্যদিকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ভোটে অনিয়মের বিষয়ে তথ্য জানার পরও নূরুল হুদা কোনো পদক্ষেপ নেননি; বরং দিনের ভোট রাতে সম্পন্ন করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন।
তিন নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বিগত তিনটি নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল একতরফা। ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন ‘ডামি ভোট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার প্রয়াত মাহবুব তালুকদার ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি।’
বিগত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে গত ২৬ জুন একটি কমিটি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিটির সদস্য মো. আবদুল আলীম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, নূরুল হুদা পদত্যাগ করতে পারতেন। সেটা না করে তিনি তৎকালীন সরকারকে সহায়তা করে গেছেন। তিনি বলেন, তিনি পদত্যাগ করলে সরকার তাঁকে হেনস্তা করতে পারত। বিপরীতে তিনি জাতির কাছে নায়ক হিসেবে গণ্য হতেন।
তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে কি না জানতে চাইলে আবদুল আলীম বলেন, শিগগিরই তাঁরা কাজ শুরু করবেন।