রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত গণমাধ্যম চান না গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ। ‘জনস্বার্থ বাদ দেওয়া’ বা ‘রক্ষা না করা’ সংবাদমাধ্যমকে গণমাধ্যম বলা যাবে কি না, সে প্রশ্নও রেখেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিক সম্মেলন ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব ‘নতুন বাংলাদেশ: কেমন গণমাধ্যম চাই’ বিষয়ে এক আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন।
‘সংবাদমাধ্যমগুলোতে তথ্যের বন্যা চলছে’ মন্তব্য করে কামাল আহমেদ দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের ‘আদর্শ ও উন্নয়ন তৎপরতা’ প্রচারে জন্যও সংবাদমাধ্যম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, “৪৬টি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এমন আবেদনপত্র আমি দেখেছি, যে টেলিভিশন চ্যানেল এখনও অপারেশনে আছে, সেই টেলিভিশন চ্যানেল তার আবেদনপত্রেই লিখেছিল, ‘আমি আওয়ামী লীগের কর্মী, আওয়ামী লীগ করেছি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আদর্শ এবং উন্নয়ন তৎপরতা প্রচারের জন্যে টেলিভিশন তৈরি করতে চাই, আমাকে টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হোক।’
“এছাড়া কোনো যোগ্যতার কথা ওই আবেদনে নেই। ওই আবেদনে কোনো মিশন স্টেটম্যান্ট নাই। সেই টেলিভিশন চ্যানেল এখনও সম্প্রচারে আছে। এ টেলিভিশনকে কি আপনি গণমাধ্যম বলবেন?”
অজস্র প্রচারমাধ্যমের ভিড়ে ‘বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ যেন হারিয়ে যায়’ এটি বিগত সরকারের ‘কৌশল’ ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, “ওই সরকার ‘সাংবাদিকতার সক্ষমতা, আর্থিক সক্ষমতা এবং বাজার’, কোনো কিছু বিবেচনায় না নিয়েই টিভি চ্যানেল খোলা ও পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দিয়েছে।”
আওয়ামী লীগ শাসনামলে ‘সম্পাদকীয় নীতিমালা’ সব সময় উপেক্ষিত থাকতে দেখার কথাও বলেন এই সাংবাদিক।
তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের পাবলিক ইন্টারেস্ট থাকা দরকার। গণমাধ্যমে জনস্বার্থ প্রতিফলিত হচ্ছে কি না, জনস্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, জনগণের পক্ষে কাজ হচ্ছে কি না, সেই টেস্ট যদি আমরা না রাখি, তাহলে সেটাকে কি আমরা টেলিভিশন বা পত্রিকা যাই হোক না কেন, আমরা তাকে কি গণমাধ্যম বলব? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আসা দরকার, আলোচনা হওয়া দরকার।”
এখন সংবাদমাধ্যমে ‘তথ্যের বন্যার মত পরিস্থিতি চলছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেই ইনফরমেশন ফ্লাডের মধ্যে ডিস ইনফরমেশন, মিস ইনফরমেশন আবার কারেক্ট ইনফরমেশনও আছে।”
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাতেই ‘প্রাধান্য’
আলোচনায় বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলমও। তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকার সংবাদমাধ্যমকে ‘নিয়ন্ত্রণে’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে।
“অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাধান্যের জায়গা হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। পরবর্তীতে কোনো রাজনৈতিক সরকার এসে যেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, “একদিকে ‘ভয়’ ও অন্যদিকে ‘রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা’ সেলফ-সেন্সরশিপের দিকে নিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে হবে।”
এই আয়োজনে টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৪ ঘোষণা করা হয়। ৩ জন সাংবাদিক ও একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেয়া হয়।
পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, “সঠিক তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণের প্রবাহ নিশ্চিতের মাধ্যমে তা করতে হবে।”
গণমাধ্যমের ওপর চাপ এখনও আছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, “গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো যদি জনস্বার্থ, জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে না পারে, তাহলে এ পরিস্থিতি পরিবর্তন কখনোই হবে না।”
প্যানেল আলোচনার শুরুতে টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি কোঅর্ডিনেটর মাসুম বিল্লাহ গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য টিআইবির সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন।
এতে সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও বিধিমালা পর্যালোচনা, ‘দলীয় স্বার্থে’ সংবাদমাধ্যমের অনুমোদন না দেওয়া, প্রেস কাউন্সিলের বদলে স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠন, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড প্রাপ্তি ও বাতিলের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা, ‘নাম সর্বস্ব’ সংবাদমাধ্যমে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ, সাংবাদিকদের জন্য ‘ভয়ডরহীন’ পরিবেশ সৃষ্টি, সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ‘মব জাস্টিসের’ বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, অভিন্ন ওয়েজ বোর্ড প্রণয়ন ও নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন, গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা ও পর্যাপ্ত বেতনভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্যানেল আলোচনা শেষে টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৪ ঘোষণা করা হয়। এ বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৩ জন সাংবাদিক ও একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেয়া হয়।
আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন চট্টগ্রামের ‘একুশে পত্রিকা ডট কম’-এর প্রধান প্রতিবেদক শরীফুল ইসলাম (শরীফুল রুকন)।
জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন “দ্য ডেইলি স্টার”-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জায়মা ইসলাম, টেলিভিশন প্রতিবেদন বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আল-আমিন হক অহন। টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগে বিজয়ী হয়েছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘তালাশ’।
বিজয়ীদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লাখ ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেয় টিআইবি। বিজয়ী প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটির জন্য সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং এক লাখ ৫০ হাজার টাকার পুরস্কার দেওয়া হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন