সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শিরাশুনি গ্রামের বিলজুড়ে গত বছরও ছিল আমনের আবাদ। কেউ কেউ ঘেরে মাছ চাষ করতেন। কেউ বুনেছিলেন সরিষা। নভেম্বর থেকে শুরু হতো বোরোর প্রস্তুতি। মৌসুম শেষে সারাবছর খাওয়ার ধান রেখে বাকিটা বিক্রি করতেন কৃষক। সব মিলে সুখেই দিন কাটছিল গ্রামের মানুষের। গত আগস্টের ভারী বৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে সুখ। বৃষ্টি ও নদীর কূল উপচে আসা পানিতে তলিয়ে গেছে বিলগুলো। এখনও গ্রামের পর গ্রাম, বিল ও হাটবাজার পানির নিচে। নিদারুণ কষ্টে রয়েছেন ৩৮ লাখেরও বেশি মানুষ।
গত ৩ নভেম্বর ভ্যানচালক তরিকুল ইসলামের সঙ্গে গ্রামটি ঘুরে দেখা যায় কষ্টের নানা চিত্র। শিরাশুনি বাজারে কথা হয় সার ও কীটনাশক বিক্রেতা শিমুল হোসাইনের সঙ্গে। তিনি জানান, বৃষ্টির কারণে গ্রামের কেউই এবার আমন চাষ করতে পারেননি। অগ্রহায়ণের শুরুতে মানুষ শীতের শাকসবজি লাগায়। কিন্তু পানি জমে থাকায় তাও সম্ভব হচ্ছে না। এতে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।
সঙ্গে থাকা ভ্যানচালক তরিকুল জানান, শুধু ভ্যান চালিয়ে সংসার চলে না। এ জন্য তিনি শীতে সবজি চাষ করেন। গত বছর নভেম্বরে কচু লাগিয়েছেন। বোরোও করেছেন। কিন্তু এবার কিছুই করতে পারছেন না। সংসারে অভাব এখন নিত্যসঙ্গী।
চায়ের দোকানে থাকা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি পৈতৃক জমিতে নিজেও বোরো চাষ করি। বিল পানিতে ডুবে থাকায় এবার চাষ করতে পারছি না। ধান না পেলে সারা বছর কী খাব, তা নিয়েই দুশ্চিন্তা বেশি।
গ্রামের মানুষ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত আগস্টে ভারী বৃষ্টিতে বিলগুলোতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এই অঞ্চলের নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেই পানি নিষ্কাশন হয়নি। উল্টো ভারী বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা পানি নদীর কূল ছাপিয়ে গ্রাম ও বিলে প্রবেশ করে। এতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। গ্রামের খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেই পানি আর নিষ্কাশন হচ্ছে না। উল্টো উঁচু বিলের পানি নিচু এলাকায় নেমে বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে ১৩টি উপজেলায়।
স্থানীয় আন্দোলনরত গ্রামবাসীর জোট পানি কমিটির তথ্যমতে, শুধু শিরাশুনি নয়; খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোরের ১২৬টি ইউনিয়নের ৭৪৯ গ্রাম এখনও পানির নিচে। এর মধ্যে যশোরের ৩১৪টি, খুলনার ২৪৬টি এবং সাতক্ষীরার ১৮৯টি গ্রাম রয়েছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন ৩৮ লাখ ৪১ হাজারের বেশি মানুষ। মাসের পর মাস বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে থাকায় অনেকেই পার্শ্ববর্তী এলাকায় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ থাকছেন স্কুল-মাদ্রাসায়। স্কুলে পানি উঠে যাওয়ায় লেখাপড়াও বন্ধ রয়েছে শিশু-কিশোরদের।
সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে থাকায়। জলাবদ্ধতার কারণে ১৩টি উপজেলার প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়নি। শীতকালীন সবজি চাষও বন্ধ। ধীরগতিতে পানি নামায় আগামী মৌসুমের বোরো চাষ নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর সার্বিক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গ্রামগুলোর অর্থনীতিতে। আয় বন্ধ, ঘরে খাবার ফুরিয়ে আসায় অভাব দেখা দিয়েছে নিম্ন আয়ের প্রত্যেক মানুষের সংসারে। বোরো আবাদও করতে না পারলে এই সংকট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভেবে দুশ্চিন্তায় স্থানীয় মানুষ।
গ্রামের মানুষ বলছেন, দুই মাস ধরে এই অচলাবস্থা চললেও পানি নিষ্কাশনে সরকারি তেমন তৎপরতা নেই। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ কয়েকটি নিষ্কাশন খাল সংস্কার করলেও অন্যরা নীরব। গত দুই মাসে স্থানীয় প্রশাসন সামান্য কিছু চাল-ডাল দিলেও সেগুলো সবাই পাননি। এত বড় দুর্যোগকে গুরুত্ব না দেওয়ায় পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।
গ্রামে গ্রামে ক্ষতচিহ্ন শিরাশুনি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, দুই পাশের বিলের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে আছে। গ্রামে যাওয়ার প্রধান সড়কের বড় অংশ পানির নিচে। নিচু ঘরবাড়ির উঠানে এখনও পানি। সড়কে মাছ ধরতে দেখা যায় সবজি বিক্রেতা ইউনুস আলীকে। তিনি জানান, তাঁর গ্রামের ১০টি বাদে বাকি সব বাড়ি পানির নিচে। বাধ্য হয়ে অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পানি জমে থাকায় শিরাশুনি পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ রয়েছে।
তালা উপজেলার হরিনগর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, শাহপুর দাখিল মাদ্রাসার একটি অংশে আশ্রয় নিয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার। এ গ্রামের বাসিন্দা এরফান আলী গাজী বলেন, দুই মাস আগের ভারী বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে হাঁটুপানি জমে যায়। ভেবেছিলাম পানি সরে যাবে। কিন্তু দুই মাসেও ঘর থেকে পানি নামেনি।
দুই সপ্তাহ পর পানিতে তলিয়ে থাকা নিজের ঘরে দেখতে এসেছিলেন সেলিনা বেগম। তিনি জানান, ঘরে পানি জমে থাকায় দুই সন্তানকে নিয়ে মালোপাড়ায় মায়ের বাড়ি উঠেছেন। মাঝে মাঝে গ্রামে এসে ঘরগুলো দেখে যান।
যুবক সেলিম হোসেন বলেন, ফেনী-নোয়াখালীতে যখন বন্যা হলো, আমরা হরিনগর গ্রাম থেকে প্রায় ৪-৫ লাখ টাকা তুলে সেখানে ত্রাণ পাঠিয়েছি। কিন্তু আমরা যে দুই মাস ধরে ডুবে আছি, আমাদের খোঁজ নেওয়ার এখন কেউ নেই।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে সাতক্ষীরা সদর ও তালা উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ১৮৯টি গ্রামের ৫৪ হাজার ২২৫ পরিবার এখনও পানির নিচে রয়েছে। জলাবদ্ধতার শিকার ৪ হাজার ৭৮২ হেক্টর আয়তনের ৫ হাজার ৭২১টি মাছের ঘের ও ৭৯৭ হেক্টর আয়তনের ১ হাজার ৮২৩টি পুকুর-দিঘি। ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু চাষের জমি ও ফসল হারিয়ে এখন যে ক্ষতি হচ্ছে, তা টাকার অঙ্কে নিরূপণ যোগ্য নয়।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, জলাবদ্ধতায় শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২০ কোটি টাকা। এখনও শত শত ঘের পানির নিচে।
চুকনগর কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও স্থানীয় পানি কমিটির সদস্য হাশেম আলী ফকির বলেন, বোরো আবাদের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে বিল থেকে এবং বিভিন্ন নদীতে পর্যাপ্ত সংখ্যক খনন যন্ত্র দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ডুমুরিয়া সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মোল্লা মোশাররফ হোসেন মফিজ বলেন, বিলে যে ধান হয়, তাতে মানুষের ভাতের কষ্ট মেটে। কিন্তু এ বছর অনেকে আমন করতে পারেনি। বোরো ধানও যদি চাষ করতে না পারে, তাহলে গ্রামের ঘরে ঘরে অভাব দেখা দেবে। তখন পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ সমকালকে বলেন, বিলের পানি নিষ্কাশনকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন