ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান তাগাদা থাকলেও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন। সরকারের উচ্চ-পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা কতখানি বজায় থাকে— সেই অভিজ্ঞতা ড. ইউনুসের সরকার আগেই পরখ করতে চায়।
সরকারের গঠিত দুটি কমিশনের একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সরকারের মধ্যে ইনফরমালি আলোচনা চলছে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে। যদিও সোমবার (৪ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত কমিশনের প্রধানদের বৈঠকের পর একজন জানান, ‘সোমবার এ বিষয়ক কোনও আলোচনা হয়নি।’
তবে আরেকটি কমিশনের এক কমিশন সদস্যের ভাষ্য, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে দেশে রাজনৈতিক প্রসেস বজায় থাকলো। এটা সরকারেরই সিদ্ধান্ত হতে পারে।’
সূত্র জানায়, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের পর ইসি গঠনে পুরনো পদ্ধতিকে আমলে নিয়ে সার্চ কমিটির গঠনের একটি বড় কারণ নির্বাচন নিয়ে সরকার আন্তরিক। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আগে পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে অবশ্য দলীয় প্রতীক বাতিল করা হবে।
সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, ‘ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে, রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সম্মত হবে কিনা, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সেটিও সরকারকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।’
‘এমনকি বড় দল হিসেবে বিএনপি মানবে কিনা, সে প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে’ বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই দফতরের সূত্রটি।
সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে পৃথক একটি কমিশন গঠনের আলোচনা শুরু হয়েছে সরকারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এখনও নির্বাচন প্রসেস নিয়ে চিন্তা করিনি। আমরা অভ্যুত্থানে শহীদ, আহত, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছি। স্থানীয় সরকার বা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন চিন্তা করছি না।’
একটি সূত্রের দাবি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চায় আগে ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচন।
সোমবার (৪ নভেম্বর) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। সে বৈঠকে চলমান বিষয়গুলোসহ নির্বাচন নিয়েও আলোচনা হয়।
বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বৈঠকে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের দ্রুততম উদ্যোগ আশা করে বিএনপি। দলের নেতারা প্রকাশ্যে নির্বাচন নিয়ে দাবিও করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে দিতে পারে, তবে বিএনপি বিরোধিতা করবে। আমি মনে করি, সরকারকে আলোচনা করেই যেতে হবে। সরকার তো আওয়ামী লীগের সরকার না। এটা তো অন্তর্বর্তী সরকার।’
আরেকটি দলের সভাপতি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আমি স্পষ্ট হতে পারিনি এখনও। তবে ধারণা করি দিতে পারে।’
বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র সোমবার (৪ নভেম্বর) জানায়, নতুন ইসি গঠনের পর ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনি আইন নিয়ে ‘নির্বাচন সংস্কার কমিশন’-এর সঙ্গে যুগপৎভাবে কার্যক্রম পরিচালনা, সংসদীয় আসন বিন্যাসের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজনে ঝুঁকবে সরকার।
সোমবার নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি জানান, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট, জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকার সমন্বয়, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং পরামর্শ গ্রহণ করার কার্যক্রম চলছে।
বিএনপির দলীয় একটি সূত্র জানায়, মূলত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান সংস্কৃতি উঠে আসবে। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, প্রার্থী-পরীক্ষা, নির্বাচনি মাঠের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে যাবে সরকার।
সংস্কার প্রস্তাব ও নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে সূত্র জানায়, নির্বাচন বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রায় সব কিছু নিয়ে কাজ করছে। জাতীয়, স্থানীয় সরকার, নির্বাচনি আইন, সংবিধানের সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাবও দেবে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে প্রস্তাব দিলেও ‘নতুন সংবিধান’ রচনার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সূত্রটি।
একটি কমিশনের সূত্র জানায়, সংবিধান সংস্কার নিয়ে আলোচনার মাত্রা বাড়বে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অস্থিরতার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
সংবিধান সংস্কার নিয়ে বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। মঙ্গলবার এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন করার আপনারা কে? পার্লামেন্ট ছাড়াই সংবিধান সংশোধন করে ফেলবেন? মনে রাখতে হবে, সংবিধান কোনও রাফ খাতা না যে যা খুশি তাই করবেন। সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখন করতে হলে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছেন, যারা স্টেকহোল্ডার রয়েছেন—তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তা করতে হবে।’
সোমবার সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আইনজীবীদের এক সভায় দেশের বর্তমান সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘কোনও ব্যক্তি কলমের খোঁচা দিয়ে এটাকে (সংবিধান) বদলাবে না। একজন ব্যক্তি যদি মনে করেন, প্রেসিডেন্টও যদি মনে করেন, এটা ভুল হচ্ছে, এটা ওনার উচিত হবে না যে কলমের খোঁচায় এটাকে চেঞ্জ করে দেবেন। জনগণের মতামত ওনাকে রাখতে হবে, নিতে হবে।’
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যে আইনে ইসি গঠন হয়েছে, এবারও সেটা দিয়েই ইসি গঠন হচ্ছে। এর দুটো কারণ, সরকার ইলেকশন প্রসেসে নিয়ে নিতে চায়। আর আমরা যখন প্রস্তাব দেবো, সেটার পর সরকার রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করবে, শেষে লম্বা প্রসেস এটা।’
‘তাহলে ইসি গঠন দেরি হয়ে যাবে অনেক, যদি আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী হয়। আমার ধারণা সরকার যেহেতু আন্তরিক, সে কারণে প্রিভিয়াস আইনে করছে। নির্বাচন প্রসেসের দিকে এগোচ্ছে দেশ, এই সিগন্যালও দিলো সরকার’- উল্লেখ করেন জাহেদ উর রহমান।
জানতে চাইলে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন দরকার। দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সরকারের সেবা থেকে বঞ্চিত। এই নির্বাচন যত দ্রুত করা যায়, সেটি দরকার।’
অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনও দরকার। কিন্তু এর আগে এখানে কিছু সংস্কার করতে করতে হবে। সংস্কার করতে হবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনি আইনেও। ২০০৭-এ তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত একটি শক্তিশালী কমিটির পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনি আইন নিয়ে কাজ হয়েছিল। সেসময় স্থানীয় সরকারের আইনগুলো যুগোপযোগী করা হয়েছিল, সেটি এখনও প্রাসঙ্গিক।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন