স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে বাংলাদেশ থেকে বৃত্তি নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করতে গেছেন অনেকেই। তাদের অনেকেই এখন দেশের নাগরিক পরিসরে বিভিন্ন প্লাটফর্মে গুরুত্বপূর্ণ
স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে বাংলাদেশ থেকে বৃত্তি নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করতে গেছেন অনেকেই। তাদের অনেকেই এখন দেশের নাগরিক পরিসরে বিভিন্ন প্লাটফর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। নামকরা অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞসহ তাদের অনেকেই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলেছেন।
আবার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আসা ব্যক্তিদের তালিকায় এমন অনেকেই আছেন, যারা বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় সরকারের নিয়োজিত ব্যক্তি হিসেবে আলোচনায় এসেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার পর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ও মস্কোর মধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠ একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এরই অংশ হিসেবে পরের দুই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে গেছে অনেক শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন দেশের নাগরিক পরিসরে চিন্তক, গবেষক ও সংগঠক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। এ সোভিয়েত অ্যালামনাইদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. আবুল বারকাত, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন প্রমুখ।
সোভিয়েত অ্যালামনাইদের মধ্যে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. কেএইচ বজলুল হক, পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর, জনতা ব্যাংক ও আইসিবির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন প্রমুখ। এছাড়া এ তালিকায় রাজনীতিতে আলোচিত ও সক্রিয় ভূমিকা রাখা ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। কুমিল্লার সাবেক সংসদ সদস্য এবং নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে টানা তিনবার মেয়রের দায়িত্ব পালনকারী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীও চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে।
সোভিয়েত অ্যালামনাইদের মধ্যে নাগরিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনকারীদের অন্যতম সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার প্যাট্রিস লুমুম্বা পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া ল স্কুলে আইন বিষয়ে আরেকটি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ১৯৮৪ সালে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে সম্মাননীয় পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. শাহদীন মালিক। জাতিসংঘসহ বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তার কর্মজীবনের শুরু ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. শাহদীন মালিক এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্কুল অব লর অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেশের সুশীল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেছেন মস্কোর প্লেখানভ ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমিকস থেকে। দেশে ফিরে বিভিন্ন নাগরিক প্লাটফর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং জেনেভা ও ভিয়েনার জাতিসংঘ অফিসে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং স্থায়ী প্রতিনিধি। তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি টানা তিন মেয়াদে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজেরও (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সিপিডিরই আরেক সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমানও পড়াশোনা করেছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। খারকভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে পিএইচডি করেছেন তিনি। পরে অক্সফোর্ড, ইয়েলসহ বিশ্বের বেশকিছু স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা কার্যক্রমও চালিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ও বহুপক্ষীয় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও কাজ রয়েছে তার। তিনি স্প্রিংগার প্রকাশিত সাউথ এশিয়া ইকোনমিক পলিসি স্টাডিজের একজন সিরিজ সম্পাদক এবং রাইজিং পাওয়ারস অ্যান্ড গ্লোবাল গভর্ন্যান্সের সম্পাদকীয় বোর্ডেরও সদস্য। এছাড়া ১২ সদস্যবিশিষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য তিনি।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সময়টায় প্রতি বছর ২০০-২৫০ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করতে গেছে। তখন রাশিয়া, আজারবাইজানসহ সোভিয়েতভুক্ত ১৫টি দেশেই শিক্ষার্থী পড়তে যেত। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর অত ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বৃত্তি কমেছে। আর ১৯৯১ সালের পর যখন সোভিয়েত ভেঙে গেল তখন মূলত এখানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমেছে। তার পরও অনেকে গেছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে শুধু রাশিয়ায়ই পড়াশোনা করতে বৃত্তি নিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে সোভিয়েত আমলে বিভিন্ন সংগঠন থেকে শিক্ষার্থী নেয়া হতো, তবে মেধার ভিত্তিতেই নেয়া হতো। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল থেকেও গিয়েছিল। কিন্তু সবাই তখন মেধার ভিত্তিতেই গিয়েছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে ঢাকা বোর্ডে মানবিকে প্রথম স্থান অধিকার করি। ফলে সরকারি বৃত্তি পেয়েছি। সরকারি বৃত্তিতে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে ১৯৭৫ সালে আমি রাশিয়া যাই। প্রথমে আমি খারকিভ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। পরে পিএইচডি করেছি মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সে সময়ের পড়াশোনা আমার চিন্তার জগতে বেশ বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। যেহেতু সমাজতন্ত্রমনা একটি দেশ ছিল তাই সবার সঙ্গে সমতা, রাষ্ট্রীয় খাতে ও পরিকল্পনা এবং নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। এগুলো ইতিবাচক দিক ছিল। এর পাশাপাশি নেতিবাচক দিকও ছিল। যেমন অতিকেন্দ্রীভূতকরণ। পরিকল্পনায় কেন্দ্রীভূতকরণের নেতিবাচক প্রভাব তাদের উৎপাদনের ওপর পড়তে শুরু করেছিল। এগুলো নিয়ে তো সমালোচনা আছেই। তবে যেকোনো বিষয়েই গবেষণার মান খুবই ভালো ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত একসময় জনতা ব্যাংকেরও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এ সভাপতি ১৯৭৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকারের মেধাবৃত্তি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যান। মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি (প্লেখানত ইনস্টিটিউট খ্যাত) থেকে অর্থনীতি বিষয়ে এমএসসিতে সব বিষয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড অর্জন করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৮২ সালে উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি মেধাবৃত্তি নিয়ে ১৯৭৩ সালে আমি রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) গিয়েছি। তখন প্রত্যেক জেলায় দুটি করে মেধাবৃত্তি ছিল। এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ দুই শিক্ষার্থীকে এ বৃত্তি দেয়া হতো। কুষ্টিয়া জেলা থেকে আমি সরকারি এ বৃত্তি পাই। রাশিয়ায় পৌঁছার পর প্রথম এক বছর ভাষাশিক্ষা গ্রহণ করি। এরপর অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমিকস থেকে পরে আমি পিএইচডি সম্পন্ন করি। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে ফেরত আসি। সে বছরই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করি। এখানে ৪০ বছর চাকরি করে ২০২২ সালে অবসরে যাই।’
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন ১৯৮২ সালে মস্কো লোমোনোসভ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে মস্কোর রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিআইডিএসে যোগ দেন ১৯৮৬ সালে। এর আগে আইএফপিআরআই, এডিবি, ডব্লিউএইচও, জাইকা, ইউএনএসকাপ, ডিএফআইডি ও ইউএনডিপির মতো সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি)। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীদের পড়তে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সত্তর-আশির দশকে মূলত মেধার ভিত্তিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদান করত। এর মধ্যে কিছু বৃত্তি আসত বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে। কিছু আসত আফ্রো-এশিয়া সলিডারিটি ও ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলের মাধ্যমে। ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমেও কিছু আসত। এ বৃত্তি নিয়েই দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিনায়ক সেন ও মোস্তাফিজুর রহমান সেখান থেকে পড়াশোনা করে আসেন। সে সময় আমি ক্ষেতমজুর কমিটিতে ছিলাম। আমি দেখেছি গণ-অভ্যুত্থানে নিহত পরিবারের সদস্যদের সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হতো। দুজন নিহত শ্রমিকের সন্তানকে তখন পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়া হয়। যতদূর জানি তাদের একজন এখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত আছেন।’
সংগীতাঙ্গনেও বৃত্তি দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার। এরই অংশ হিসেবে তিমির নন্দী ১৯৭৩ সালে সংগীত কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের বৃত্তি পেয়ে সংগীতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সেখানে যান। সংগীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী তিমির নন্দী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সে সময় বঙ্গবন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে শিক্ষা চুক্তি করলেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭৩ সালে মেধাবৃত্তি পেয়ে রাশিয়া পড়তে যাই। সংগীত ও কোরিওগ্রাফিতে আমরা মোট ছয়জন রাশিয়া যাই। মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডির পারমিশন পেলাম। তখন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পিএইচডির অনুমতি নেয়ার জন্য আমি দেশে ফিরে আসি। কিন্তু তৎকালীন এরশাদ সরকার অনুমতি দেয়নি।’
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিতদেরও অনেকেই ছিলেন সোভিয়েত অ্যালামনাই। তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান। এ পদেই রেকর্ডসংখ্যক বার থেকেছেন তিনি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় তার মেয়াদ বর্ধিত করা হয় পাঁচবার।
১৯৭৫ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে মস্কোর পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্রপ্রকৌশলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পরই দেশে ফিরে আসেন। যুক্ত হন ফিলিপস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রেও (আইসিডিডিআর,বি) এক দশক কর্মরত ছিলেন তিনি।
অধ্যাপক কেএইচ বজলুল হক শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান (২০০৯-২০১৪) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি (২০২২-২০২৩) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছর তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য এবং বন ও পরিবেশ উপকমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দুবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। রাশিয়ার ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি থেকে ১৯৮২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. হোসেন মনসুর মস্কো জিওলজিক্যাল প্রসপেক্টিং ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেছেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক এ শিক্ষক ২০০৯ সালের ১৮ অক্টোবর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হিসেবে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। দুই দফায় তার নিয়োগের মেয়াদ আরো চার বছর বাড়ানো হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখনো স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি।
কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনে ২০২১ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি। এরপর ২০ জানুয়ারি ১৯৮০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে প্রথমে মাস্টার্স (এমএস) ও পরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৮৩ সালে দেশে ফেরেন তিনি।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম ওসমানকে হারিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন আরেক সাবেক সোভিয়েত অ্যালামনাই ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি পান তিনি। ওডেসা পিরাগোব মেডিকেল ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি লাভ করে ১৯৯২ সালে দেশে ফেরেন তিনি। ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্ন হিসেবে ভর্তি হন। তখনই রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হন তিনি। ১৯৯৩ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে পান নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্ব। সে বছরই ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকার সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন তিনি।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএম মাহফুজুর রহমান উচ্চ শিক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যান ১৯৭২ সালে। তিনি রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৯ সালে অর্থনীতিতে দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দেশে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময় তিনি আইসিবির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এ সাধারণ সম্পাদককে ২০২০ সালে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য নিযুক্ত করা হয়। একই বছর তিনি জনতা ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০২৩ সালে তাকে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানও মস্কোর ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলএম ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। এছাড়া সেখান থেকে সাংবাদিকতায়ও ডিপ্লোমা করেছেন তিনি। দেশে ফেরার পর ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে যোগ দেন তিনি। পরে বিভাগটির অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, আইএলওর মতো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও পড়িয়েছেন।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে টানা নয় বছর ছিলেন অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন। তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন ১৯৮৩ সালে প্লেখানভ রাশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকসে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরও শেষ করেছেন তিনি। দীর্ঘসময় শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগে। ২০১১ সালের ১৫ মে তিনি বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। এ পদে নয় বছর পূর্ণ করে ২০২০ সালের মে মাসে বিদায় নেন তিনি। পরে ২০২৩ সালের মে মাসে খায়রুল হোসেনকে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। তবে গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পিকেএসএফের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন