নিম্ন দরদাতা বাদ দিয়ে কার্যাদেশ বাড়তি ব্যয় ৭০০ কোটি টাকা
কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নে যোগ্যতা অর্জন করেছিল। আন্তর্জাতিক দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবেও মনোনীত হয়েছিল। এর পরেও ‘চাহিদা নেই’ এমন অজুহাতে কাজ দেয়া হয়নি কনসোটিয়াম অব একসিইএল ইনফ্রাসট্রাকচার-এনার্জিস পাওয়ার করপোরেশনকে। বিপরীতে একই স্থানে দায়মুক্তি আইনের আওতায় বিনা টেন্ডারে উচ্চ মূল্যে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। উচ্চ মূল্যের কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে ১৫ বছরে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ৭০০ কোটি টাকা। আর এ অর্থ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কেটে নেয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগী কোম্পানিটি প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি কিনেছিল। মাটি ভরাটসহ উন্নয়ন কাজও করা হয়েছিল। তার আগে সহস্রাধিক পৃষ্ঠার দরপত্র তৈরি করা ও কনসালট্যান্ট নিয়োগ, বিদেশী বিনিয়োগকারী অনুসন্ধান করা হয়। এ জন্য প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচও হয়। এরপরও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ না পেয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছেন কোম্পানিটি।
ভুক্তভোগী কোম্পানিটির একজন মালিক হলেন জাভেদ হোসেইন, যিনি দেশের প্রখ্যাত আইনবিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মরহুম ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেইনের ছেলে।
জানা গেছে, চাঁদপুর, চৌমুহনী, বাগেরহাট, বগুড়া, জামালপুর, ফেনী, মেঘনাঘাট, ঠাকুরগাঁও, রংপুর এবং সান্তাহারে প্রতিটি ১০০ মেগাওয়াট (+-১৫%) ক্ষমতার ১০টি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০১৬ সালের ১৯ মে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। এ দরপত্রে কনসোর্টিয়াম অব একসিইএল ইনফ্রাস্ট্রাকচার-এনার্জিস পাওয়ার করপোরেশন অংশগ্রহণ করে। কোম্পানিটি শান্তাহার এবং বাগেরহাটের বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। এতে প্রথমে কাজ করার যোগ্যতা যাচাই করা হয়। শিকলবাহায় এনার্জিস পাওয়ারের ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল। আর এর মাধ্যমেই কারি১গরি মূল্যায়নে আলোচ্য কোম্পানিটিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় যোগ্য বলে বিবেচিত করা হয়। এরপর আর্থিক সক্ষমতায়ও টিকে যায় কোম্পানিটি। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করার কথা। কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক কারণে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) দেয়ার জন্য ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হচ্ছিল না। জানা গেছে, বাগেরহাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের দর, ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যেও সর্বনিম্ন ছিল। কিন্তু আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির সব রকম উপযুক্ততা এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সান্তাহার এবং বাগেরহাটের জন্য মনোনীত প্রস্তাব দুটি বাদ দিয়েই বাকি আটটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরণ করে এবং দরদাতাদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করা হয়।
এদিকে, শান্তাহার ও বাগেরহাটে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২২ বিঘা করে জমিও কেনা হয়েছিল। জমি উন্নয়নসহ সামগ্রিক কাজ সম্পন্ন করতে প্রতিটি প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনুমানিক ব্যয় হয়েছিল ৫ কোটি টাকা করে।
এদিকে উচ্চ আদালত থেকে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এলওআইয়ের জন্য কেন প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে না এ বিষয়ে আদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। এদিকে, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকেও আলোচ্য কোম্পানিকে কাজ দেয়ার বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই বলে মতামত দেয়া হয়। এসব মতামতের ভিত্তিতে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু কমিটিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়, শান্তাহার ও বাগেরহাটে কোনো বিদ্যুতের চাহিদা নেই। অথচ টেন্ডার আহ্বানের সময় শান্তাহার ও বাগেরহাটে বিদ্যুতের চাহিদার ভিত্তিতে ১১৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য আগ্রহীদের কাছে দরপত্র চাওয়া হয়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নে যোগ্যতা অর্জন ও সর্বনি¤œ দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের ছেলের কোম্পানি বলে কাজ দেয়া যাবে না এমন একটি অভিযোগ উঠেছিল। আর এ কারণে নানাভাবে তাদের অযোগ্য করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রাথমিক দিকে বলা হয়েছিল সান্তাহারে জমিতে বিরোধ আছে। এমন একটি চিঠি দেয়া হয়েছিল। হুবহু আরেকটি চিঠি বাগেরহাট থেকেও দেয়া হয়েছিল। তারা বিষয়টি চালেঞ্জ করায় অবশেষে সে চিঠি দুটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আর শেষে কোনো কিছুই তাদের অযোগ্য করতে পারেনি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিশেষ নির্দেশে তাদের কাজ বাতিল করে দেয়া হয়।
এদিকে বিদ্যুতের চাহিদা নেই বলে একদিকে তাদের টেন্ডার বাতিল করে দেয়া হয়। বিপরীতে ওই স্থান দুটিতে উচ্চমূল্যের দুটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আর এ দুটি উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে উচ্চ মূল্যে। এ কারণে ১৫ বছরে শুধু বিদ্যুৎ কেনা বাবদ সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে ৭০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে এনার্জিস পাওয়ার করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ হোসেইন গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আমরা বিশ্বাস করি সিদ্ধান্তটি পূর্ববর্তী শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে প্রভাবিত এবং আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের আগে ওই এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা নিরুপণ ব্যতিরেকে দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করা হয় নাই। অপর দিকে, আমাদের বিদুৎ উৎপাদন প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত সান্তাহার এবং বাগেরহাট এলাকার সন্নিকটে দরপত্র আহ্বান না করেই ১৫ বছর মেয়াদি দুটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ২০১৯ সালের ৩০ মার্চে এবং অপরটি ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবরে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে এসেছে। এতে প্রতীয়মান হয় শান্তাহার ও বাগেরহাটে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। তিনি বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকৌশলগত কারণে একটি জটিল প্রক্রিয়া যার কারণে সহস্রাধিক পৃষ্ঠার দরপত্র তৈরি, সাইট ভিজিট, জমি ক্রয়, কনসালটেন্ট নিয়োগ, বিদেশী বিনিয়োগকারী অনুসন্ধানে ব্যাপক সময় ও অর্থ ব্যয় করি। আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এর প্রতিকার চাচ্ছি।