বাংলাদেশে ঋণ-বাণিজ্যে এগিয়ে চীন, পিছিয়ে ভারত!
বাংলাদেশে ঋণ-বাণিজ্যে এগিয়ে চীন, পিছিয়ে ভারত!
বাংলাদেশের দুই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র চীন ও ভারত। বাংলাদেশের উন্নয়নে দেশ দুটির বড় অবদান রয়েছে। বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তার দিক থেকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন। আবার ভারতের চেয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যও বেশি।
সম্প্রতি হাসিনা সরকারের পতনের পর এই দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে আরো বড় প্রভাব পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনেতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা গেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে ৩৯ কোটি ডলার। আর ভারত দিয়েছে ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের শেষ দিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েনে কমে যায় ঋণ সহায়তার পরিমাণ।
সর্বশেষ পাঁচ অর্থবছরের ঋণছাড়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ অর্থবছরে চীন বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা দিয়েছে ৩৮৪ কোটি ডলার। আর গত পাঁচ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা দিয়েছে ১২৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ ভারতের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন। এদিকে গত পাঁচ অর্থবছরে ভারত মাত্র এক কোটি ২৫ লাখ ডলারের নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সেখানে চীন দিয়েছে ৩৮২ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি।
এদিকে ভারতের ঋণের প্রকল্পগুলোতেও রয়েছে নানা জটিলতা। গত অর্থবছরে চারটি বড় প্রকল্পে ভারতের ঋণ বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে চীনের ঋণে পদ্মা রেল সেতু, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। যদিও দুই দেশেরই প্রকল্প প্রসেসিংয়ে কিছুটা জটিলতা রয়েছে।
তবে ভারতের প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা ধরনের শর্ত রয়েছে। যেটা চীনের ক্ষেত্রে কম।
প্রায় দুই দশক আগে ভারতের এক্সিম ব্যাংক প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) ধারণা নিয়ে বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেওয়া শুরু করে। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু। এক্সিম ব্যাংক ভারতের রপ্তানি, বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশকে ঋণ সহায়তা দিতে থাকে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট পায়। তিনটি এলওসি ঋণসহ বর্তমানে ভারতীয় ঋণের মোট প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ৭৯৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে অর্থছাড় করেছে ২৪৪ কোটি ডলার।
সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, আগের মতোই এই সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেবে ভারত। ভারত থেকে বাংলাদেশের ঋণের অর্থছাড় করার বিষয়েও সমস্যা নেই।
এদিকে গত পাঁচ বছরে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে আড়াই গুণ। বেড়েছে আমদানিও। গত ১০ বছরে ভারত থেকে আমদানি বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। এক যুগ ধরে ট্রানজিট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলেছে। তবে এ ক্ষেত্রে আলোচনাই বেশি হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের পথ এখনো চালু হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত এক যুগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ হয়েছে। বাণিজ্য বৃদ্ধির আরো সম্ভাবনা আছে। ট্রানজিটসহ দুই দেশের পণ্য ও যাত্রী চলাচল নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, বাস্তবে তত অগ্রগতি হয়নি।
২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। এর পরের ১০ বছরে আমদানি বেড়েই চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি কিছুটা কমে এক হাজার ৬৩ কোটি ডলার হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৭১৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে। ভারত হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি উৎস। শীর্ষে রয়েছে চীন। সেখান থেকে মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে।
বাংলাদেশের আমদানি করা ভারতীয় পণ্যের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তুলা। মোট আমদানি খরচের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয় তুলা আমদানিতে। এরপর আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য। এরপর রয়েছে রেলের বগি, ইঞ্জিনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ।
এদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৪ শতাংশ হয় পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ এই দেশটির সঙ্গে। বিপুল অর্থের পণ্য চীন থেকে আমদানি করলেও দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয় খুবই কম। তার পরও দেশটির সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্য বাড়ছে। দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে।
যদিও মোট রপ্তানির মাত্র ১.২২ শতাংশ যায় দেশটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে এক হাজার ৯৮১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, আর রপ্তানি হয়েছে ৬৮ কোটি ডলারের। সেই হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি এক হাজার ৯০০ কোটি ডলারের বেশি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর। গত এক মাসে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি দুই-ই কমেছে। দুই দেশের বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। ওই বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, জুলাই মাসের চেয়ে আগস্ট মাসে বেনাপোল দিয়ে আমদানি কমেছে সোয়া তিন কোটি কেজির বেশি।
একই সঙ্গে রপ্তানি কমেছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ কেজি। আখাউড়ায় কমেছে ৬৮১ টন। হিলি বন্দর দিয়ে আমদানি নেমেছে অর্ধেকে। অন্য বন্দরগুলো দিয়েও আমদানি-রপ্তানি কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। ভারতে দর বেশি হওয়ায় সম্প্রতি চীন, মিসর, থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ পেঁয়াজ আমদানি করছে। তবে বাণিজ্য নিরুৎসাহিত করতে সরকার পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।