‘বিলাসী’ খেজুরে দামের দ্বিগুণ শুল্ক
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার এসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খেজুরকে বিলাসী পণ্য ধরে শুল্ক নির্ধারণ করে। ফলে খেজুর আমদানি করতে প্রকৃত দামের প্রায় অতিরিক্ত দ্বিগুণ-তিনগুণ শুল্ক দিতে হয়। তাই সবার সহযোগিতা না পেলে বাজারে খেজুরের দাম কমানো যাবে না বলে জানিয়েছেন। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত ‘আসন্ন পবিত্র রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও সামগ্রিক দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। তবে ব্যবসাবান্ধব কাস্টমস এবং ভ্যাট কাঠামো চান ব্যবসায়ীরা।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১১০ টাকা কেজি দরে আমদানি করা খেজুরে শুল্ক দিতে হয় ১৪০ টাকা। পরে বাজারে বিক্রি করতে হয় ২৫০ টাকায়। একইভাবে ১২০ টাকা কেজির খেজুরে ২১০ টাকা শুল্ক দিয়ে বাজারে ৩৩০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। এজন্যই বাজারে খেজুরের দাম এত বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই শুল্ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ গত বছর এক কেজি খেজুরে মাত্র ১০ টাকা শুল্ক দিয়েছি।
তিনি বলেন, ইফতারের সময় মুসলমানরা অন্তত দুই-তিন টুকরো খেজুর খেয়ে থাকেন। গত ৩৫ বছর ধরে আমি খেজুর আমদানি করি, কিন্তু কখনো শুল্ক দিতে হয়নি। আমি খেজুর আমদানি করলাম ৯০০ থেকে ১০০০ ডলারে। চট্টগ্রামের কাস্টম কমিশনার সাধারণ কনটেইনার খেজুরের জন্য ২৫০০ ডলার এবং হিমায়িত কনটেইনারে খেজুরের জন্য ৪০০০ ডলার শুল্ক নির্ধারণ করেছে। এতে খেজুরের দাম দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। আমরা এনবিআর-এ কথা বলেছি, তারা কোনো যুক্তি দেখাতে পারলো না কেন এটার শুল্ক ২৫০০/৪০০০ করলো। এই অ্যাসেসমেন্টে এক কার্টন খেজুর আমাকে বিক্রি করতে হবে সাড়ে ৪০০০ টাকায়, কেজি পড়বে ৪৫০ টাকা। আসলে আমরা সবাই যদি সহযোগিতা না করি, তাহলে বাজারে খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম রাখতে পারবো না।
সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, রমজান মাস ইবাদতের মাস। আপনারা সারা বছর ব্যবসা করেন, রমজান মাসেও ব্যবসা করবেন। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে ফেস্টিভ্যালে ছাড় দেয়া হয়। আমাদের দেশেও তেমন হতে হবে। রমজান মাসে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাপ্লাই চেইনে ঘাটতি হলে আর্টিফিসিয়াল ক্রাইসিস তৈরি হবে। এটা যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসা করি লাভ করার জন্য, তবে সেই লাভ হতে হবে ন্যায্য।’ রমজান মাসে ‘বিক্রি বেশি, মুনাফা কম’-এই নীতিতে ব্যবসা করলে ব্যবসায়ী, সমাজ ও দেশ লাভবান হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অসৎ ব্যবসায়ীর পক্ষে এফবিসিসিআই কথা বলবে না জানিয়ে সভাপতি বলেন, রমজানে বাজার মনিটরিং পুলিশ দিয়ে করানো হোক তা চাই না। বাজার কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনিটরিং করলেই হয়। আপনারা এটা না করলে সরকারিভাবে হয়রানির শিকার হতে হবে। এটা আমরা চাই না। অসৎ ব্যবসায়ীর পক্ষে এফবিসিসিআই কোনো কথা বলবে না।
তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, পথে চাঁদাবাজির শিকার হলে আমাদের জানাবেন। আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি আলাপ করবো।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, কর দিচ্ছেন, ভ্যাট দিচ্ছেন। তারপরও দিন শেষে একটি কথা থেকে যায়। সেটা হলো, ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করছেন। এসব যেন আর না হয়- সেজন্য আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। সংকট আছে। যেমন বাজারে ডলার সংকট আছে, ব্যাংকে গেলে সময়মতো ঋণপত্র খোলা যায় না। এটা ঠিক যে আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ব্যবসা করি। তবে আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে, বাজার ঠিক রাখতে হবে। পাইকারি বাজারের ৮০০ টাকার দামের পাঞ্জাবি খুচরা বাজারে গিয়ে যেন ৫ হাজার টাকা হয়ে না যায়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
মতবিনিময় সভায় শ্যামবাজার মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মাজেদ বলেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বাজারে মুড়িকাটা পিয়াজ আসবে। তখন পিয়াজের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে নেমে আসবে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সিনিয়র সভাপতি বলেন, উৎপাদক পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি ১৭০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করে। দাম সহনীয় রাখতে খুচরা ও আড়তদারদের সঙ্গে ভোক্তা অধিকারের আলোচনা প্রয়োজন।
সমাপনী বক্তব্যে এফবিসিসিআই’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী বলেন, অসাধু কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে এফবিসিসিআই নাই। তাদের বিরুদ্ধে সবসময় পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাশাপাশি এফবিসিসিআই থেকেই এবার বাজার মনিটরিং করা হবে।
রমজানে ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, মসলা ইত্যাদির দাম বাড়লে রেস্তরাঁ মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে জানান বাংলাদেশ রেস্তরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান। এ বিষয়ে এফবিসিসিআই উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে তাকে আশ্বস্ত করেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
এদিকে ব্যবসায়ীরা জানান, শিল্পের জন্য কাঁচামাল কিংবা যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ, অযৌক্তিক জরিমানা, এইচএস কোড সংক্রান্ত জটিলতা এবং মিথ্যা ঘোষণার নামে নানাবিধ হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বহুবার আলোচনার পরও সুফল মিলছে না। যা ‘ইজ অব ডয়িং বিজনেস’ বাস্তবায়নে অন্তরায় বলে মনে করেন তারা।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট, আয়কর এবং কাস্টমস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব বিষয়ে ব্যবসায়ী মহলকে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এদিকে পণ্যের এইচএস কোড ইস্যুতে রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হলেও ফলাফল মিলছে না। আমরা সরকারকে অগ্রিম আয়কর দিচ্ছি, কিন্তু সেটি আর রিফান্ড হচ্ছে না। এসব বিষয় ব্যবসা-বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে, ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট-ট্যাক্স দেয়ার বিপক্ষে নয় উল্লেখ করে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে চাই। তবে সেটি যেন অযৌক্তিক না হয়। এ সময় কাস্টমস এবং ভ্যাট কাঠামো সহজীকরণ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্ট পরামর্শ চান এফবিসিসিআই সভাপতি।
কমিটির ডিরেক্টর ইনচার্জ এবং এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ড. মুনাল মাহবুব বলেন, সত্যিকারের ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য কাস্টমস এবং ভ্যাট কর্তৃপক্ষকে বেসরকারি খাতের অসুবিধার কথা আন্তরিকতার সঙ্গে শুনতে হবে। গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মো. মুনির হোসেন, পরিচালকরা, কমিটির কো-চেয়ারম্যানরা, সদস্যরা ও ব্যবসায়ী নেতারা।