Image description
২০০ কোটি টাকা দিয়ে সংস্কার, ৬ মাসেই নষ্ট
ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কটি দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন বিভাগের ১৯ জেলার সড়কপথে যোগাযোগ ও ব্যাবসায়িক পণ্য পরিবহনের একমাত্র লিংক রোড। এ সড়কের কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব পর্যন্ত ৫৬ কিলোমিটার অংশের অন্তত ২০ কিলোমিটার ভেঙেচুরে এখন আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০ কোটি টাকা দিয়ে সংস্কার, ৬ মাসেই নষ্ট২০১৯ সালের শেষ দিকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ৫৬ কিলোমিটার মহাসড়ক সংস্কার করে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে প্রায় অর্ধেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। কোথাও কোথাও ফেটে ও দেবে যায়। কোথাও বা ফুলেফেঁপে ওঠে। তেলবাহী লরি, মালপত্রবাহী ট্রাকসহ প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন এই সড়কে চলাচল করছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে সাড়ে তিন বছর ধরেই এই সড়কে যাতায়াত করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে যাত্রীরা। ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। মালপত্রবাহী গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। ধীরগতির কারণে মালবাহী গাড়ি থেকে পণ্য খোয়া যাচ্ছে। এমনকি রাতে ডাকাতি, ছিনতাইয়েরও শিকার হতে হচ্ছে চালকদের। অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনাও। ভুক্তভোগী যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা জানান, নিম্নমানের ঠিকাদারি কাজ এবং সওজের তদারকির অভাবে সংস্কারের ছয় মাসেই সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সওজ এখন জোড়াতালি দিয়ে সড়কটি সচল রাখার চেষ্টা করছে। দুর্ঘটনা, ডাকাতি নৈমিত্তিক ঘটনা সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের এক-তৃতীয়াংশজুড়েই ভাঙাচোরা। এলাকাবাসী ও পুলিশ জানায়, সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় বনগ্রাম ইউনিয়নের তিলাকান্দা গ্রামের মাছের খামারি জামশেদ আলী (৪০) মারা যান। জামশেদের মাছ বহনকারী টমটমটি আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যপাড়ায় ভাঙা রাস্তায় উল্টে পড়ে। এ সময় অন্য দিক থেকে আসা একটি কভার্ড ভ্যান তাঁকে চাপা দিয়ে চলে যায়। পুলিশের সূত্র বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরে এই সড়কে কমপক্ষে ১৬৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভৈরব হাইওয়ে থানার ওসি মো. সাজু মিয়া জানান, ২০২১ সাল থেকে তিন বছরে তাঁর এলাকায় মোট ৫৮টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছে। কটিয়াদী হাইওয়ে থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানান, তিন বছরে তাঁর থানা এলাকায় ৩০টির মতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবছর গড়ে তিন-চারজনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে পুলিশের দেওয়া এসব তথ্য অসম্পূর্ণ বলেই মনে করেন এই পথে চলাচলকারী যাত্রী ও ব্যবসরায়ীরা। তাঁদের মতে, বেশির ভাগ দুর্ঘটনার খবরই পুলিশ পায় না। ঝুটঝামেলা এড়াতে ভুক্তভোগীরাও পুলিশের কাছে কম যায়। ভাঙাচোরা রাস্তায় ধীরগতির মালবাহী গাড়িতে ডাকাতি হচ্ছে। কয়েকজন চালক জানান, গাড়ির পেছন থেকে মালপত্র গায়েব হয়ে যাচ্ছে। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার পাবইকান্দির সিএনজি অটোচালক শফিকুল ইসলাম টুটুল জানান, ভাঙা সড়কে ঝাঁকুনিতে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ খুলে পড়ছে। মেরামত করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা। বাঁক আছে, বিভাজক নেই সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ সদরের বড়পুল থেকে কটিয়াদী পর্যন্ত বাঁক রয়েছে ৪১টি। এর মধ্যে পুলেরঘাট থেকে ১২ কিলোমিটারে বাঁকের সংখ্যা ২৫। বিআরটিএ সূত্র জানাচ্ছে, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সাতটি বাঁকে দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ সওজ এসব বাঁকে সড়ক বিভাজক করছে না। সওজ সূত্র জানায়, সড়কের ভাঙাচোরা অংশ মেরামতের জন্য ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিভাগের কর্মীরা ঢিবি সমান করছেন। খাদের মতো গর্তে ইটের সলিং বিছিয়ে দিচ্ছেন। এতে দুর্ভোগ কিছুটা কমলেও কাজের কাজ তেমন হচ্ছে না। সড়কের যেখানে যে হাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের দাবি, সাত-আট কিলোমিটার এলাকা ভাঙাচোরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। কিশোরগঞ্জ সদরের পূর্ব লতিবাবাদ, বড়পুল ও নান্দলা এলাকায় কয়েক কিলোমিটার সড়কে ফাটল ধরেছে। পাকুন্দিয়ার পুলেরঘাট বাজার এলাকায় বড় বড় গর্ত। কটিয়াদীর মাইজহাটি, ঘিলাকান্দি, বানিয়াগ্রাম বাজার এলাকায় ফেটে ও ফুলেফেঁপে গেছে বেশ কিছু জায়গা। একই উপজেলার গাঙকূলপাড়া, আচমিতা ও চারিপাড়ায় সড়ক দেবে গেছে। কটিয়াদী সদরের বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে বাজিতপুরের উজানচর মোড়ের আগ পর্যন্ত তিন-চার কিলোমিটার সড়ক মারাত্মক এবড়োখেবড়ো। উজানচর মোড় পার হয়ে কুলিয়ার চরের শেষ সীমানা পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার সড়কের দুরবস্থা বর্ণনার বাইরে। সওজ ভেঙে যাওয়া সড়কে বিটুমিনের প্রলেপে মোটা দানার লাল বালুও মিশিয়ে দিচ্ছে। মালবাহী গাড়ির চালকরা বলছেন, এ ধরনের সংস্কারের ফলে রাস্তাটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের কিশোরগঞ্জ অফিস সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব পর্যন্ত আঞ্চলিক মহাসড়কের ৫৬ কিলোমিটার সড়কের দুই বছর মেয়াদি সংস্কারকাজ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। দুই ভাগে প্রায় ১৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এই অংশের সংস্কার কাজ করা হয়। এরমধ্যে ২৭ কিলোমিটার ৯৬ কোটি টাকায় ও বাকি ২৯ কিলোমিটার ৯২ কোটি টাকায় সংস্কার করা হয়। সূত্র মতে স্পেকট্রা ইঞ্জি. লি. অ্যান্ড তাহের ব্রাদার্স জেভি এবং রিলায়েবল বিল্ডার্স (র‌্যাবআরসি) প্রা. লি. ও এনডিএ জেভি নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরো সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্তাব্যক্তি যা বলছেন সড়ক ও জনপথের বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রিতেশ বড়ুয়া গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে জানান, ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কের একাংশ সংস্কারের জন্য করা টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তবে এখনো সেটা ফ্লোটিং (ভাসমান অবস্থায়) আছে। রিসিভ হয়নি, যে কারণে কার্যাদেশও পাওয়া যায়নি। কবে নাগাদ কার্যাদেশ মিলবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা আমার জানা নেই। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।’