মইনুল ইসলাম
গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘ক্লাসিফায়েড লোনের’ হিসাব প্রকাশ করেছে প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। মাস দুয়েক আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কেউ কেউ জানিয়েছিলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকারও বেশি হবে।
আমি বহু বছর ধরে বলে চলেছি যে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ক্লাসিফায়েড লোনের হিসাব জনগণের সঙ্গে ‘ভয়ানক প্রতারণা’। কারণ খেলাপি ঋণের তিনটি প্রধান ক্যাটেগরিকে টেকনিক্যাল কারণে এ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।
প্রথমত, অর্থঋণ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যেসব খেলাপি ঋণের মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন হিসেবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সেগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ক্লাসিফায়েড লোনের’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই ক্যাটেগরির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, যেসব মন্দঋণ (খেলাপি ঋণ) পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো হয়ে গেছে সেগুলোকে ব্যাংকগুলো চাইলে এবং তাদের সক্ষমতা থাকলে ‘রাইট অফ’ বা অবলোপন করতে পারে। সক্ষমতার প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে, ‘রাইট অফ’ করা খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলোকে প্রভিশনিং করতে হয়। প্রভিশনিং করার মানে হলো, ‘রাইট অফ’ করা মন্দ ঋণের সমপরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ প্রদান করা যায় না এবং ‘রাইট অফ’ করা মন্দ ঋণের হিসাব ব্যাংকের মূল লেজার থেকে সরিয়ে অন্য আরেকটি লেজারে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। ফলে যে ব্যাংক মন্দঋণ রাইট অফ করে তাদের ঋণ প্রদানের ক্ষমতা ওই পরিমাণ সংকুচিত হয়ে যায়। সে জন্য বাংলাদেশের প্রায় সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিশাল অঙ্কের ‘প্রভিশনিং শর্টফল’ রয়েছে। মানে, ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ ‘পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো মন্দঋণ’ রয়েছে, অত পরিমাণের মন্দঋণ কোনো ব্যাংকই ‘রাইট অফ’ করে না, অনেক কম করে। অবশ্য রাইট অফ করা মন্দঋণকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড লোনের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের সব ব্যাংক থেকে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা রাইট অফ করা হয়েছে। অতএব এই ৬৭ হাজার কোটি টাকাকেও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণের সঙ্গে যোগ করতেই হবে। রাইট অফ করা মন্দঋণ খেলাপি ঋণ বিধায় সেগুলো আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোর সচেষ্ট থাকার কথা, কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-
জামায়াত জোট সরকার রাইট অফ প্রথা চালু করার পর ২৩ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও ৫ শতাংশ রাইট অফ করা মন্দঋণও কোনো ব্যাংক আদায় করতে পারেনি।
তৃতীয় ক্যাটেগরি হলো আইনানুগভাবে যতবার ঋণ রিশিডিউলিং (পুনঃতপশিলীকরণ) করা যায়, তার চাইতে বেশিবার রিশিডিউল করে কোনো ঋণকে নিয়মিত দেখানো কিংবা নতুন ঋণ অনুমোদন করে পুরোনো খেলাপি ঋণকে ওই নতুন ঋণের মধ্যে অ্যাডজাস্ট করে দেখানো। এ দেশের অনেক ব্যাংক এই অবৈধ উপায়টি ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করে থাকে। দুঃখজনকভাবে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং ও সুপারভিশনকে ফাঁকি দিয়ে ব্যাংকগুলো এই মহাজনি পন্থাটি অনুসরণ করে বিধায় এ পদ্ধতিতে কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ প্রতিবছর ব্যাংকগুলো কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলছে, সেটি অজানাই রয়ে যাচ্ছে।
দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ঋণের সর্বশেষ হিসাব প্রকাশিত হয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকার সামান্য বেশি। তাই বলা যায়, অবৈধভাবে রিশিডিউলিং করা ঋণের হিসাব বাদ দিলেও খেলাপি ঋণের প্রকৃত অনুপাত মোট ঋণের ৪২ শতাংশের মতো। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত
‘ক্লাসিফায়েড লোন’ মোট ঋণের মাত্র ১৬ শতাংশ। এর মানে, খেলাপি ঋণ সংকটের প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি ভয়াবহ। এই ৪২ শতাংশ অনুপাত শুধু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নয়, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বোচ্চ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, পাকিস্তানের চাইতেও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংকট বেশি গুরুতর। আরও গুরুতর হলো, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্কের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, এর ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন, দশ বছর ধরে প্রতিবছর গড়ে ১২ বিলিয়ন থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচারকৃত এই অর্থের সিংহভাগই ছিল ব্যাংক ঋণ, যা হুন্ডি পদ্ধতিতে পাচার হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে কত লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, তা সঠিকভাবে জানা যাবে না কোনো দিনই।
মোদ্দাকথা হলো, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সামান্য পরিমাণে আদায় করতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারকে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যার কোনো কূল-কিনারা পেতে হলে অবিলম্বে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণখেলাপিকে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিন-চারটি ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাবটি ১৯৯৮ সালে দিয়েছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর প্রদত্ত বিআইবিএমের ‘প্রথম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায়’। দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে তাঁর চাইতে বেশি আর কে জানত? তাঁর ওই প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি তখনকার সরকার। পরে ২৬ বছর ধরে আমি এই দাবি বারবার তুলে ধরা সত্ত্বেও কোনো সরকারই এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। এখন যখন ব্যাংকিং খাতের প্রায় ১০-১১টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে তখন সরকারের টনক নড়বে কিনা, সেটিই প্রশ্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর খেলাপি ঋণ আদায়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। টাস্কফোর্সকে সফল হতে হলে ট্রাইব্যুনাল গঠনকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতেই হবে, নয়তো ব্যর্থতা প্রায় অবধারিত। আমার আরেকটি প্রস্তাব হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর ক্লাসিফায়েড লোনের যে হিসাব প্রকাশ করে থাকে, তার অংশ হিসেবে বিভিন্ন আদালতে মামলার বিষয়বস্তু হিসেবে কত খেলাপি ঋণ আটকে রয়েছে, তার সর্বশেষ হিসাব এবং কত খেলাপি ঋণ ‘রাইট অফ’ করা হয়েছে, তারও সর্বশেষ হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হোক।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ
অর্থনীতি সমিতি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন