প্রায় পাঁচ লাখ বিদেশি নাগরিক ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। যাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। অবৈধ বিদেশিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত যেসব বিদেশি নাগরিক বৈধ হননি, তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন) আহ্বায়ক করে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের অনেকেই মাদক ব্যবসা, উপহারের নামে প্রতারণা, হেরোইন, ব্যাংকের এটিএম ব্যুথে জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো, মানবপাচারসহ সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্রের সঙ্গে জড়িত। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে কর ফাঁকি দিয়ে উপার্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে নিজের দেশে পাচার করে নিয়ে যান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ বিদেশি নাগরিকরা ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ভিসা নিয়ে বৈধ না হলে কিংবা ভিসা না থাকা অবস্থায় ধরা পড়লে তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল সরকার। গত ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, দেশে অনেক বিদেশি আছেন। তাদের কোনো ভিসা নেই। অনেকেই চাকরিও করছেন। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ভিসা না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশ্য এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর অবৈধ বিদেশিদের ব্যাপারে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই দিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, অবৈধভাবে কোনো বিদেশি নাগরিকদের সরকার বাংলাদেশে থাকতে দেবে না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের কাছে এক লাখ ২০ হাজার বিদেশি নাগরিকের তথ্য রয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের মতো। যাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। বিদেশি এসব নাগরিকের অনেকেই নানা অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছেন। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে গ্রেফতারের পর বর্তমানে ৪৭২ জন কারাগারে রয়েছেন। ১৬৯টি দেশের নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, যাদের পাসপোর্ট ও ভিসার মেয়াদ অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ৫০ হাজারের বেশি। চীন, পাকিস্তান, কানাডা, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়ার মতো উন্নত দেশের কিছু নাগরিকও অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। অবৈধভাবে অবস্থান করছেন নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মালি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ঘানা, গিনি, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, অ্যাঙ্গোলা, পেরু, আলজেরিয়া, চীন, ইউক্রেন ও থাইল্যান্ডের নাগরিকরাও। বিদেশি এসব নাগরিক ভ্রমণ, ব্যবসা, শিক্ষার্থী, খেলোয়াড় এবং অন অ্যারাইভাল বা পোর্ট এন্ট্রি ভিসায় এই দেশে প্রবেশ করেছেন। অবৈধ অবস্থানকারীদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে তথ্য আছে। আইনি দুর্বলতা ও বিদেশি নাগরিকদের সমন্বিত কোনো তথ্যভা-ার না থাকায় বিনা বাধায় বাংলাদেশে অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, দেশে বর্তমানে কতজন বিদেশি নাগরিক বৈধ ও অবৈধভাবে অবস্থান করছেন তার হালনাগাদ সঠিক কোনো তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। এ বিষয়ে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসবির এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশিদের তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২ লাখ ২০ হাজারের মতো বিদেশি নাগরিকের তথ্য রয়েছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ১ লাখের বেশি বিদেশি অবৈধ হয়ে গেছেন। সারা দেশে বিদেশিদের তালিকা করা হচ্ছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশে অবস্থানরত বৈধ নাগরিকদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন প্রায় ৫০ হাজার। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক ভারতীয় নাগরিক চলে গেছেন। আবার কিছু নাগরিক এসেছেনও। তারা আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন। ফলে বর্তমানে কত সংখ্যক ভারতীয় নাগরিক এ দেশে কাজ করছেন তার হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
কারা অধিদফতরের এআইজি জান্নাত-উল-ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশের কারাগারগুলোতে ৪৭২ জন বিদেশি নাগরিক বন্দি রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি বন্দি ভারতের। এর পরই আছে মিয়ানমার ও পাকিস্তানের নাগরিক। এ ছাড়া নাইজেরিয়া, উগান্ডা, ঘানাসহ কয়েকটি দেশের বন্দি রয়েছেন বাংলাদেশের কারাগারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিকে আটকের পর দেখা যায় তার কাছে কোনো পাসপোর্টই নেই। অনেক সময় তারা ইচ্ছা করে পাসপোর্ট গোপন করেন বা ফেলে দেন। এ অবস্থায় এই বিদেশি নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর আগে নাগরিকত্ব নির্ধারণের প্রয়োজন হয়, যা সময়সাপেক্ষ। আবার অনেক দেশের দূতাবাস ঢাকায় নেই। এমন দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব যাচাই করা আরো বেশি জটিল। এ ছাড়া অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তারা মামলার অজুহাতেও এ দেশে থেকে যান। তাদের রাখার জন্য আলাদা ডিটেনশন সেন্টারও নেই।