রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টকে (সিএ) ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়েছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। অফিস থেকে ফেরার পথে প্রথমে কয়েকজন লোক তাঁকে নিয়ে জটলা সৃষ্টি, এরপর পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। অনুসন্ধান বলছে, এই চক্রের সঙ্গে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা-পুলিশের একটি দলও যুক্ত রয়েছে। তাদের মূল শক্তি তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান।ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিএমপি) শেখ সাজ্জাদ আলী পুরো ঘটনা শুনে হতভম্ব। ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি সাজানো বলেই মনে হয়েছে। কমিশনারের দাবি, ঘটনার ব্যাপারে তাকে অন্ধকারে রেখেছিলেন উপ-কমিশনার। ঘটনাটি ঘটেছে গত রবিবার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায়। সেদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে প্রতিদিনের মতো বাসায় ফিরছিলেন একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের অডিট অফিসার মো. হাসান আলী।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার রহমানের রেগনাম সেন্টার ভবনে থাকা অফিস থেকে বের হচ্ছেন হাসান। সঙ্গে দুই সহকর্মী বাশার ও ইমাম হোসেন। তিনজন এসকেএস স্কাই ভবনের ফুটপাত ধরে হেঁটে পুলিশ প্লাজার দিকে যাচ্ছিলেন। হাসান অফিস থেকে বের হওয়ার পর তার পিছু নেয় অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি। হাসান হেঁটে এসকেএস স্কাই ভবনের সামনে গেলে আচমকা চারদিক থেকে ৮-১০ জন লোক তাকে ঘিরে ধরে। এরপর কিল-ঘুষি দিতে থাকে। হালকা গড়নের এক ব্যক্তি হাসানের পকেটে একটি ছোট ‘প্যাকেট’ ঢুকিয়ে দেয়।ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসানের সহকর্মী ইমাম হোসেন বলেন, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন পুলিশ সদস্য সেখানে হাজির হন। আবু ঈসা নামে একজন এসআই ছিলেন পোশাক পরে। পুলি সদস্যরা জোর করে হাসানকে গাড়িতে তুলে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে থাকা লোকগুলো সটকে পড়েন। পুলিশ সদস্যরা জানান, তার পকেটে ইয়াবা পাওয়া গেছে। হাসানকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় নেওয়ার পর হাজতে ঢুকিয়ে রাখা হয়।
ইয়াবা উদ্ধারের কথিত এই অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার উপ-পরিদর্শক আবু ঈসা একেক সময় একেক কথা বলেন। প্রথমে তিনি দাবি করেন, সোর্সের মাধ্যমে তিনি খবর পেয়েছেন হাসান ইয়াবা নিয়ে আসছেন। আবার বলেন, ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশে তখন তিনি অবস্থান করছিলেন।তবে থানা পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সময় ওই এলাকায় ঈসার কোনো ডিউটিও ছিল না। আবার সহকারী কমিশনার (এসি) রব্বানী হোসেন বলেন, ঘটনার দিন থানার কুইক রেসপন্স টিমের সদস্য ছিলেন ঈসা। খবর পেয়ে তিনি সেখানে যান।
অনুসন্ধান বলছে, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসান আলীকে থানায় আনা হয়। তার কাছে পাওয়া প্যাকেটে ১৯৩ পিস ইয়াবা আছে বলে দাবি করে পুলিশ। খবর পেয়ে ছুটে আসেন হাসানের সহকর্মী ও স্বজনেরা। ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন স্বজনেরা। থানা পুলিশ দায় এড়িয়ে ডিসি বিষয়টি দেখছেন বলে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। হাসানের মামা সরকারি কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান মধ্যরাতে ছুটে যান ডিসির কাছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে সন্দেহভাজন কিছু না মনে হওয়ায়, পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে হাসানকে ছেড়ে দেবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন ডিসি । হাসানের মামা কামরুজ্জামানকে ডিসি বলেন, হাসানকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।ডিসির কথায় আশ্বস্ত হয়ে থানায় ফিরে আসেন কামরুজ্জামান। থানায় এসে তিনি ওসি ও এসির সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ডিসি নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।স্বজনদের অভিযোগ, ডিসি হাসানকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে মূলত স্বজনদের ব্যস্ত রাখেন, যাতে তারা ডিএমপির ঊর্ধ্বতনদের কাউকে জানাতে না পারেন। পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি ডিসির কথামতো থানায় যান হাসানের মামা ও সহকর্মীরা। পুলিশের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী থানায় আসেন তেজগাঁও জোনের এডিসি ও এসি। তারা ওসির কক্ষে হাসানকে নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর মধ্যে তারা হাসানের পিসিপিআর, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন, মোবাইল কললিস্ট, শিক্ষা-কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই করেন। তবে পুলিশ তার বিষয়ে সন্দেহজনক কোনো কিছু পায়নি বলেও স্বজনদের জানায়। এরপর শুরু হয় হাসানকে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া।
৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হাসানকে তার মামা মো. কামরুজ্জামানের জিম্মায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় থানা পুলিশ। এসআই আবু ঈসা ও এসআই জিহান হোসাইনকে ওসি গাজী শামীমুর রহমান একটি জিম্মানামা লিখে তাতে কামরুজ্জামানের সই নিতে বলেন। পরিদর্শক তদন্তের কক্ষে বসে জিম্মানামা লেখেন ওই দুই এসআই। জিম্মানামায় সই করেন হাসানের মামা কারুজ্জামান। এসআই ঈসা জিম্মানামায় উল্লেখ করেন, ‘কতিপয় লোক এক ব্যক্তিকে আটক করেছে খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে হাসানকে সুস্থ অবস্থায় তাকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হলো।’ হাসানকে যখন পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তখনই এসআই ঈসার কাছে একটি ফোন আসে। এরপর হাসানকে মুক্তি না দিয়ে আটক রাখা হয়।জানতে চাইলে এসি রব্বানী হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি অনেক নিচের কর্মকর্তা। ওপরের কর্মকর্তারা যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন, সেভাবেই কাজ হচ্ছে।হাসানের স্বজনদের অভিযোগ, এক কক্ষে জিম্মানামা নিতে ব্যস্ত রেখে অন্য কক্ষে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন ডিসি। যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারেন। পরে স্বজনরা যখন ডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন তিনি মামলা হয়েছে বলে তাদের জানিয়ে দেন। ডিসি ইবনে মিজান বলেন, সদর দপ্তরের চাপে তিনি মামলা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এ ঘটনা নিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ডিএমপি সদর দপ্তরে বসে কথা বলেন অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এসএম মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেন ফাঁসানো না হয়, সে ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। জানতে চাইলে, গত সোমবার নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমারও মনে হয়েছে হাসান ভিকটিম হচ্ছেন, তাই ডিসিকে এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু মামলা কেন হলো তা বুঝতে পারছি না।’ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় এসআই আবু ঈসার করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা এ মামলায় উল্লেখ করেন, ২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় একজন লোককে জনগণ আটক করেছে এমন খবর পান তিনি। এরপর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে সেখানে যান। আসামি হাসানকে থানায় নিয়ে আসেন। একটি পলিথিনের প্যাকেটে ১৯৩ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে। তবে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসানকে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এর আগে থেকেই এসআই ঈসা সেখানে ছিলেন। তাকে মধ্যরাতে আটক করা হয়েছে, এই তথ্য সঠিক নয়।এই মামলায় দুজনকে সাক্ষী করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজনের নাম মো. নাঈম। হাসানকে যে ভবনের সামনে মারধর করা হয়েছে, সেই এসকেএস স্কাই বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তাকর্মী তিনি।
ঘটনা সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ভবনের সামনে অনেক লোকের ভিড় দেখেন। তবে সেখানে কী হয়েছে সেটা তিনি জানতে পারেননি। পরে ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশের একটি দল তাঁর কাছে আসে। তারা জোর করে কাগজে তার দুটি স্বাক্ষর নেয়। তিনি কোনো ইয়াবা দেখেননি। তাকে যে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে, তাও জানেন না এই নিরাপত্তাকর্মী। অপর সাক্ষীর নাম সেলিম মিয়া। গাড়িচালক এই ব্যক্তিকে মামলার সাক্ষী করা হলেও তিনি ঘটনার বিষয়ে স্পষ্ট কিছুই বলতে পারেননি।মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা দেওয়ার বিষয়ে মামলার বাদী এসআই আবু ঈসার সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের৷ তিনি বলেন, ‘সেদিন তার প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে সাদা কাগজে ওই জিনিসগুলো(ইয়াবা) পাওয়া যায়। তারপর থানাসহ আমারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাকে মোটরসাইকেলে করে থানায় নিয়ে যাই। এরপর সেখানে আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যে নির্দেশনা আসে সেই অনুযায়ী মামলা হয়েছে৷’ঘটনার দিন থেকে মামলা হওয়া পর্যন্ত অপরাপর সময়ে নানা অসঙ্গতির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই আমি ঢাকায় নতুন এসেছি। এই শহরের কালচার সম্পর্কে কিছুই জানি না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমি সেভাবেই কাজ করেছেছি।’
এমন মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের জানালে, নিজের অপরাধকে ঢাকতে ডিসি ইবনে মিজান দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তিনি হাসানের স্বজন, সহকর্মী ও তার কর্মস্থলের লোকজনকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকেন। বিষয়টি জানাজানি হলে, ভবিষ্যতে হাসানের এই মামলায় ক্ষতি হবেও জানান তিনি। জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি গাজী শামীমুর রহমান বলেন, কর্মকর্তারা যা বলছেন, তিনি তা-ই করেছেন। হাসানকে আদালতে ওঠানোর পর আদালত হাসানকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তিনি বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।সার্বিক বিষয়ে ডিসি ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাদ আলী। তিনি পুরো ঘটনার জন্য বারবার দুঃখ প্রকাশ করেন । অধীনস্ত কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেও বলেন তিনি।