আমার স্বামীর তো কোন অপরাধ ছিল না। কোনো সন্ত্রাসীও নয়। সেনাবাহিনী আমাকে আশ্বস্ত করেছিল আমার স্বামীকে কিছুই করবে না। আমার বিশ্বাসও ছিল তাদের ওপর। যে সেনাবাহিনী জুলাই-আগস্টে জনতার পক্ষে ছিল তারাই পুরো শরীরে এমন নিষ্ঠুর নির্যাতন ও কারেন্টের শক দিয়ে তাঁকে হত্যা করলো। চার সন্তানকে কেন এতিম করা হলো। আমি এর বিচার চাই।’
কুমিল্লায় যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার পর হাসপাতালে মারা যাওয়া যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের (৪৫) মরদেহ নিয়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনে এসব কথা বলেন তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার। পাশে একটি অ্যাম্বুলেন্সে রাখা ছিল মরদেহ। এ সময় মাইক হাতে নিয়ে কেঁদে কেঁদে স্বামী হত্যার বিচার চান তিনি। মা যখন তাদের বাবা হত্যার বিচার চেয়ে বক্তব্য রাখছিলেন তখন পাশে দাঁড়ানো চার সন্তানও কাঁদছিল। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে ‘সচেতন এলাকাবাসী’ ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে স্বজন ও এলাকার সহস্রাধিক মানুষ সমবেত হয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন ইয়াসমিন।
ঘটনার রাতে (বৃহস্পতিবার) তৌহিদুরের সঙ্গে প্রতিবেশী লুৎফুর রহমানকেও আটক করা হয়। মানববন্ধনে হাজির হয়ে তিনি বলেন, ঘটনার রাত থেকে পুলিশে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত তৌহিদুলকে নির্যাতন করা হয়। তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না। সকালে গোমতীতে নামিয়ে গোসল করানোর পর নামাজ পড়তে বলা হয়েছিল। আমি নামাজ পড়েছি, তৌহিদ দাঁড়াতে পারেনি।’
তৌহিদুলের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘সেনাবাহিনীর পোশাক ছাড়াও ওই রাতে কিছু লোক সিভিলে ছিল। তাদের মুখ ঢাকা ছিল। তারা বলেছিল আমার স্বামীকে ফেরত দেওয়া হবে। সে নাকি অস্ত্র ব্যবসা করে। ভোর থেকে আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অনেকের কাছে গিয়েছি, মোবাইলে কথা বলেছি। তাকে পাইনি। সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার পর আবারও সেনাবাহিনীর লোকজন তাকে (স্বামী) গাড়িতে রেখে আমাদের ঘরে তল্লাশি করেছে। তখন আমার স্বামী অনেকটা অচেতন ছিল। পরে হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর আমাদের খবর দেওয়া হয়।’
মানবন্ধনে তৌহিদুলের ভাগ্নি প্রফেসর মাহবুবা উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত দফায় দফায় আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সেনা আইনে বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। আমাদের একটি বিশ্বাস ও গর্বের স্থান সেনাবাহিনী। এভাবে একটি মানুষকে নির্যাতন করে মারা হলো। দেশে আইন ও বিচার বলে কি কিছুই নেই? আমরা যদি ন্যায়বিচার না পাই তাহলে বিধি অনুসারে আইনগত পদক্ষেপ নেব।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুমিল্লা মহানগর শাখার সদস্য সচিব রাশেদুল হাসান বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আমরা এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। সেনাবাহিনী জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে জনতার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করেছে। এভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু আমাদের কষ্ট দেয়। আশা করি, ওই ব্যক্তির পরিবার এর বিচার পাবে।’
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যৌথবাহিনীর পরিচয়ে কিছু সেনা সদস্য ও সিভিলে থাকা ব্যক্তি তৌহিদকে বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তিনি জেলার আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবি ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের মৃত মোখলেছুর রহমানের ছেলে ও ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চার দিন আগে বাবা মারা যাওয়ার খবরে বাড়ি আসেন। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তাঁকে কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
তৌহিদের স্ত্রী ও স্বজনদের অভিযোগ- মরদেহ গোসল করানোর সময় তাঁর শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।
শনিবার দুপুরে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এ ঘটনায় থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের পর সন্ধ্যায় মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের পর দুপুরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
ওসি জানান, ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করার অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তৌহিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা ছিল। এছাড়া আর কোনো অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে।