দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলা ও আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও দেশ ছেড়েছেন অ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক লুৎফুল্লাহ মাজেদ। বুধবার (২৯ জানুয়ারি) রাতে তিনি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। বিমানবন্দরের নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আসিফ হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এখনও এ বিষয়ে জানি না। তবে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাবো। পাশাপাশি অন্য আসামিদের বিষয়েও বলবো।’
মামলার অন্য আসামিরা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, তারাও যেকোনও মুহূর্তে দেশ ছাড়তে পারেন। এর আগেও মামলা হওয়ায় এবং বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় বেবিচকের অনেক কর্মকর্তা দেশ ছেড়েছেন।
তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২৭ জানুয়ারি ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ এসব মামলা দায়ের করা হয়।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হক, সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী) মো. হাবিবুর রহমান, অ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল আলম ও পরিচালক লুৎফুল্লাহ মাজেদ প্রমুখ।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জানান, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। তারা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত ১৫ বছরে দেশের মামলার আসামিরা বিভিন্ন বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও আত্মসাৎ করেছেন।
মামলা দায়েরের পরের দিন (২৮ জানুয়ারি) প্রধান আট আসামির বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। তারা যেন কোনোভাবেই দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে বিষয়ে দেশের সব বন্দর, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।
বিমানবন্দরের একটি সূত্র জানায়, বুধবার রাত ১২টার দিকে মালিন্দ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে লুৎফুল্লাহ মাজেদ ঢাকা ছাড়েন। আলোচিত মামলার আসামি ও দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার পরও কোনও ধরনের বাধা ছাড়াই চলে যান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটির প্রধান উইং কমান্ডার জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ইমিগ্রেশন বিভাগের ডিআইজির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও মন্তব্য করেননি।
তবে বিমানবন্দরের সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি খুবই উদ্বেগজনক বিষয়। আলোচিত মামলার আসামি, আদালতের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তিনি কীভাবে পালান?’
তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা আসতে হয়তো কিছু সময় লাগছে, কিন্তু তাদের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও বিমানবন্দরে কর্মরত নিরাপত্তা কর্মীরা কোনও ব্যবস্থা নিলো না, এটি আশ্চর্যজনক।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এর আগেও বর্তমান ট্রাইব্যুনালের আসামিরা চলে গেছেন। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? নিরাপত্তার নামে বিমানবন্দরে আসলে হচ্ছেটা কী?’
অভিযোগ উঠেছে, এই মামলার অন্য আসামিরাও দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে বেবিচকের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী দেশত্যাগের বিষয়ে নানা চেষ্টা চালাচ্ছেন। এছাড়া পালাতে পারেন এমন তালিকায় সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেকেরও নামও রয়েছে।
বেবিচকের বর্তমান এই প্রধান প্রকৌশলী সংশ্লিষ্টদের কাছে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ নামে পরিচিত। অথচ ‘অদৃশ্য শক্তির’ বলে গত নভেম্বর মাসে তিনি এই পদে নিয়োগ পান। ওই সময় তার বিরুদ্ধে দুদকের দুটি মামলা চলমান ছিল। সর্বশেষ দুদক বিমানবন্দর উন্নয়নের নামে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে আরও চারটি মামলা দায়ের করে। এই মামলাগুলোর আসামিদের মধ্যেও তিনি অন্যতম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তার দুর্নীতির বিষয়ে সবাই জানে। এরপরও তিনি অদৃশ্য শক্তির বলে প্রধান প্রকৌশলী হয়ে যান। মার্চেই তার অবসরে যাওয়ার কথা। এর আগে তিনি তার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এই পদে আরও দুই বছর থাকার জন্য সবকিছু ম্যানেজ করেন। একটি প্রস্তাবনাও তৈরি হয়। শুধু চেয়ারম্যানের সই বাকি ছিল। কিন্তু এই মামলা ও তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নির্দেশনা বেবিচকে আলোচনার জন্ম দেয়। এক পর্যায়ে বুধবার (২৯ জানুয়ারি) তার প্রস্তবনাটিতে চেয়ারম্যান আর সই করেননি। মামলা ও বিচার এড়াতে তিনিও যেকোনও সময় দেশ ছাড়তে পারেন বলে গুঞ্জণ রয়েছে।
এর আগে নানা অনিয়ম করে দেশ ছেড়ে গেছেন বেবিচকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল খালেক। তিনি প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে পরিবার নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমান। আর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুজ্জামানও ১৫০ কোটি টাকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সবমিলিয়ে বেবিচকের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ১০ কর্মকর্তা অনিয়ম ও লুটপাট করে বিচার এড়াতে দেশ ছেড়েছেন।