জানুয়ারি দেশের শীতলতম মাস। কথায় আছে, ‘পৌষের শীত মোষের গায়, মাঘের শীত বাঘের গায়।’ পৌষের ১৪ দিন আর মাঘের ১৭ দিন মিলে জানুয়ারি। কিন্তু এবারের জানুয়ারিতে বাঘ পালানো শীত দেখা গেল না। রাজধানী ঢাকা তো বটেই, সারা দেশেও শীত পড়েছে অন্যবারের চেয়ে কম।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবারের জানুয়ারি মাসে দেশে একটিও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। যদিও প্রতিবছর অন্তত একটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয় এ মাসে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহহীন জানুয়ারি দেখা গিয়েছিল ৯ বছর আগে, ২০১৬ সালে। এবার জানুয়ারিতে গড় তাপমাত্রাও ছিল অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি, বিপরীতে কুয়াশা কম পড়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের লেপ, তোশক ও কম্বল বিক্রেতা এমরান হোসেন গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারি মাসে তিনি মাত্র তিনটি লেপ বিক্রি করতে পেরেছেন। ক্রেতা একেবারেই কম। তিনি বলেন, ‘শীতই নাই। মানুষ কিনব ক্যান এসব?’
কৃষি, রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও অর্থনীতির ওপর শীত কম পড়ার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম শীত মানে ডেঙ্গু আরও বিস্তারের সুযোগ তৈরি হওয়া; গম, আলু ও শর্ষের মতো ফসল উৎপাদনে ক্ষতি এবং শীতকেন্দ্রিক ব্যবসা কমে যাওয়া।
ঢাকাসহ বড় শহরে কম শীত পড়লে মানুষকে বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যান চালাতে হয়। অফিস-আদালতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসিও চলে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যায়। জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে আবার বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে চাপ পড়ে।
সবচেয়ে বড় দিক হলো, এভাবে শীত কমে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যা নানা দিক দিয়ে সংকট তৈরি করতে পারে।
দিনে কুয়াশার ব্যাপ্তি এবার কম হওয়ায় শীতের অনুভূতি খুব কম।আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক
শীতল মাসে উষ্ণতা
শীত কতটা পড়ে, তা দুইভাবে বোঝা যায়। এক. শীতের অনুভূতি দিয়ে। দুই. তাপমাত্রার মাধ্যমে। যদি দিনের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর কম হয়, তাহলে শীত বেড়ে যায়। এবারের জানুয়ারি মাসে তিন দিন (২ থেকে ৪ জানুয়ারি) এই পার্থক্য গড়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছিল।
টানা তিন দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে তা শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য হয়। শৈত্যপ্রবাহের আবার চারটি ধরন আছে—মৃদু (সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), মাঝারি (৬ দশমিক ১ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস), তীব্র (৪ দশমিক ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও অতি তীব্র (৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে)। এবার জানুয়ারিতে দেশে শুধু একটি মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে। সেটি ছিল ১০ জানুয়ারিকেন্দ্রিক। ওই দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল।
■ শীত কম পড়ার চারটি কারণের কথা বলছেন আবহাওয়াবিদেরা। ■ কৃষি, রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও অর্থনীতির ওপর শীত কম পড়ার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, জানুয়ারি মাসের স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছরের জানুয়ারির গড় তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৭।
এবারের জানুয়ারিতে দেশে কোনো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে ২০২৪ সালে চারটি, ২০২৩ সালে একটি এবং ২০২২ ও ২০২১ সালে তিনটি করে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়েছিল।
ঘন ও দীর্ঘ সময় কুয়াশাও এবার জানুয়ারি মাসে তেমন একটা দেখা যায়নি। দিন তিনেক একটানা কুয়াশা দেখা গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, গত বছরের জানুয়ারি অথবা আগের পাঁচ বছরে ঘন ও দীর্ঘ সময় কুয়াশা ছিল অন্তত সাত দিন। অতি ঘন কুয়াশা হলে ৪৫ মিটার দূরের বস্তু দেখা যায়। আর ঘন কুয়াশায় দেখা যায় অন্তত ১৮০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত। এবার দেখা গেছে তার চেয়ে অনেক দূরের বস্তু।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, দিনে কুয়াশার ব্যাপ্তি এবার কম হওয়ায় শীতের অনুভূতি খুব কম।
চার কারণে শীত কম
আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার তথ্য পর্যবেক্ষণ করে। তার একটি ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ইসিএমডব্লিউএফ)। গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে সংস্থাটি জানিয়েছিল, তখন বাংলাদেশের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৬৮ শতাংশ।
বিভিন্ন গবেষণায় উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া আছে। এর একটি দৃশ্যমান বিষয় হবে শীতের বিস্তৃতি বা পরিধি কমে যাওয়া। বাংলাদেশেও তাই ঘটছে।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, সাধারণত বছরের এ সময়ে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি থাকে না। এবার জানুয়ারি মাসজুড়ে বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য ছিল। এ কারণে জানুয়ারি মাসে স্বাভাবিক শীত পড়েনি। তাঁর ব্যাখ্যা হলো, জলীয় বাষ্পের বিভিন্ন স্তরে সূর্যের তাপ সঞ্চিত থাকে। ফলে বায়ুমণ্ডলের উঁচু স্তর থেকে শীতল বায়ুপ্রবাহে বাধা তৈরি হয়।
শীত কম হওয়ার আরও তিনটি কারণের কথা বলছেন আবহাওয়াবিদেরা—এক. উচ্চ চাপ বলয় না থাকা। দুই. বজ্রমেঘ সৃষ্টি না হওয়া। এবং তিন. ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপোলের (ওআইডি) নিরপেক্ষ অবস্থান।
কোনো স্থানে বায়ুর চাপ আশপাশের এলাকার চেয়ে বেশি হলে তাকে উচ্চ চাপ বলয় বলা হয়। এই অঞ্চলে বায়ুচাপ বলয় প্রাধান্যশীল থাকলে ওপর থেকে আসা বায়ু শীতের তীব্রতা বাড়ায়। এবার সেই বায়ুচাপ বলয় প্রাধান্যশীল ছিল না বলেই শীতলতম মাস জানুয়ারি অনেকটাই তার বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে, এমন মত আবহাওয়াবিদদের।
এবার পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে বজ্রমেঘ কম সৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বজ্রমেঘ বৃষ্টিপাত তৈরি করে। বৃষ্টি হলে শীতলতা বাড়ে। এবার তা–ও নেই। অন্যদিকে ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপোলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত দোলন। এর তিনটি ধাপ আছে। সেগুলো হলো ইতিবাচক, নেতিবাচক ও নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ থাকলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
শুধু জানুয়ারি নয়, আগের মাস ডিসেম্বরেও দেশের সার্বিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বেশি ছিল। ওই মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এ মাসে দু-একটি মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ডিসেম্বরে মাত্র দুটি মৃদু এবং একটি মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, এবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মডেলে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, তা মেলেনি। শীত অপেক্ষাকৃত কম পড়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর বেশ কিছু তৎপরতা এর কারণ।
এটা কি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফল
বৈশ্বিক আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের এ এযাবৎকালের উষ্ণতম বছর। গত বছর তাপমাত্রা শিল্পায়ন-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৫৫ সেন্টিগ্রেড বেশি ছিল বলে সংস্থাটির হিসাবে দেখা গেছে। ২০২৪ সালে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ও সাগরের তাপমাত্রা ১ দশমিক ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল, যা ১৮৫০ থেকে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক ধরে গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া আছে। এর একটি দৃশ্যমান বিষয় হবে শীতের বিস্তৃতি বা পরিধি কমে যাওয়া। বাংলাদেশেও তাই ঘটছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে বাড়তে পারে।
প্রভাব কী
শীতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বিস্তার কমে। যদি শীতের তীব্রতা ও বিস্তার কমে, তাহলে ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শীত বেশি পড়লে এডিস মশার বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রয়োজনীয় শীত না পড়লে গম, আলু ও শর্ষের মতো ফসল চাষে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা ব্যাখ্যা করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) শস্য উৎপাদন শাখার পরিচালক শওকত ওসমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শীত কম পড়লে এসব ফসলের ফুল কম ফোটার আশঙ্কা থাকে। এমন প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, গমের ক্ষেত্রে তাপসহিষ্ণু জাতের বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু আলু বা শর্ষের তা নেই। তাই এসব ফসল এবার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।