আবুল হাসান। পেশায় একজন শিক্ষক। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। মঙ্গলবার ভাগ্নের জন্য জন্মসনদ করতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৩ এর অফিসে। সেখান থেকে আঞ্চলিক অফিস, নগর ভবন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘুরেছেন। শেষে খিলগাঁওয়ে অবস্থিত অঞ্চল-২ এর কার্যালয় থেকে জন্মসনদ হাতে পান। জন্মনিবন্ধন করতে হয়রানির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবুল হাসান বলেন, কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন কার্যালয়ে জন্মসনদ করার জন্য ঘুরেছি। সিটি করপোরেশনের ভিতরে আবেদন করা যায় না, বাহির থেকে করা লাগে। অথচ এই কাজগুলো তাদেরই। অনলাইনে আবেদন করে দিতে বললে তারা নানা টালবাহানা করে। পরে দোকান থেকে আবেদন করি। আঞ্চলিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর নিতে গেলেও ঝামেলায় পড়ি। এই ভবন থেকে অন্য ভবনে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। তিনি বলেন, অঞ্চল-৩ থেকে নগর ভবনের ১৫ তলায় যেতে বললে সেখানে যাই। কিন্তু সেখানে জন্মনিবন্ধের কোনো কার্যক্রম নেই। সরকারের অন্য একটি দপ্তর খোলা হয়েছে। লিগামেন্ট ইঞ্জুরি নিয়ে আবার ১৫ তলা থেকে আবার ৮ তলায় যাই। আবেদনে ভুল থাকায় আবেদনটির সুরাহা হয়নি। পরে ভুল সংশোধনের জন্য সেখান থেকে আবার অঞ্চল-২ এ আসতে হয়। অনলাইন সংশোধনের পর তা অনুমোদনের জন্য আবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে বলা হয়। তিনি বলেন, এতসব হয়রানি কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়। কত মানুষের ভোগান্তি। কারও বাবা মারা গেছে, কেউ জন্মনিবন্ধন বানাচ্ছে। প্রত্যেক জায়গায় ভোগান্তির শিকার মানুষ।
শুধু হাসান নন, জন্মনিবন্ধন পেতে এভাবে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। সরজমিন ঢাকা সিটির বিভিন্ন জোন ঘুরে এমন দুর্ভোগের চিত্র চোখে পড়ে।
জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে গুলশানের ৩৯ নং ওয়ার্ড নূরের চালা থেকে এসেছেন হাসিব ও সাজ্জাদ। দু’জন শিক্ষার্থী। একজনের পিতা-মাতার জন্মস্থান ঢাকার বাহিরে কিন্তু তিনি নিজে ঢাকায় জন্ম নেয়া। অন্যজনের মাতার জন্মস্থান ঢাকায় বাবার জন্মস্থান ঢাকার বাহিরে। সাজ্জাদ ও হাসিব বলেন, দেখেন নিয়ম অনুযায়ী আমাদের জন্মসনদটা হয়ে যাওয়ার কথা, এখন তারা অযথাই হয়রানি করাচ্ছে। এই জন্মসনদ ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারছি না। তারা সরাসরি বলে দিয়েছে এখানে হবেই না। আমরা অনলাইনে আবেদন করেই আসছি, কথা ছিল এখানে জমা দিলেই হয়ে যাবে। তারা বললো জন্মস্থান যে জায়গায় দেয়া সেখানেই করতে হবে। এখন আমরা জন্মনিবন্ধন ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। তারা যদি চায় এক হাজার টাকা দেন তবুও করতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এর কার্যালয়ের নিবন্ধক সহকারী আব্দুল মান্নান জানান, জন্মস্থান এখানে (উত্তর সিটি) হলে, জন্মস্থান এখানে বা স্থায়ী ঠিকানা এখানে হলে আমি সনদের ব্যবস্থা করতে পারি। সেবাগ্রাহীতারা বাহির থেকে অনলাইনে আবেদন করে কাগজপত্রসহ এখানে এলে আমরা করে দেই। এখানে কোনো হয়রানি নাই। কাগজপত্র দিয়ে গেলে আমি ডেট দিয়ে দেই। ১৫ দিন সময় লাগে হয়তো। জন্মনিবন্ধন কার্ড রেডি হলে মেসেজ যায়। মেসেজ গেলেই একদিন পর এসে নিয়ে যেতে পারে।
দুপুর ১২টা। রেগে গিয়ে চিৎকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় ৫ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন মানিক নগর মিয়াজান লেনের বাসিন্দা শরীফ। জন্মনিবন্ধনে তার বাবার নাম সংশোধন করার জন্য ১০ দিন ধরে এই কার্যালয়ে ঘুরছেন কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। একদিন গেলে বলে হোল্ডিং ট্যাক্স এর ফটোকপি লাগবে, আরেকদিন বলে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন এভাবে দিনের পর দিন কাগজপত্র নিয়ে ঘুরছেন এই আঞ্চলিক অফিসে। বৃহসপতিবার এই অফিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার আবেদনটি গ্রহণ করেননি, তারা বলছেন নতুন করে জন্মনিবন্ধন আবেদন করতে। তাই রাগে অভিমানে চিৎকার করে বের হয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন- আমার আবেদন যদি গ্রহণ না করে তাহলে আমাকে কেন এতদিন ধরে বিভিন্ন কার্যালয়ে ঘুরালো। আমি তো বাবার নাম সংশোধন করার জন্য আবেদন করেছি তাহলে আমার আবেদন গ্রহণ করবে না কেন। এইখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ফাজলামি করা হচ্ছে আর কিছুই না। আমার সব কিছুই ঠিক আছে শুধু বাবার নাম এর শেষে আলম বসবে এইটার জন্য আমার এই জন্মনিবন্ধন বাদ দিয়ে নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে হবে এইটা ফাজলামো ছাড়া আর কিছুই না। শুধু তিনি নন, শরীফ ছাড়া এমন অনেক বাসিন্দা জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সরজমিন ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয় গিয়ে দেখা মিলেছে এইসব দৃশ্যের। সরকার ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করায় নাগরিকরা জাতীয় পরিচয়পত্র করার জন্য জন্মনিবন্ধন সংশোধন সহ নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া প্রতিটি স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ায় স্কুলে ভর্তির সময় শিশুদের জন্মসনদ চাওয়া হয় স্কুল থেকে। সময়মতো জন্মনিবন্ধন পেতে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে অভিভাবকদের। উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ছোটখাট সংশোধনের জন্য তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে দিনের পর দিন ঘোরানোর কারণে সময় অপচয়, প্রয়োজনীয় কাজে জন্মনিবন্ধন জমা দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে পিতামাতার জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে নামের মিল নেই জাতীয় পরিচয়পত্রের। এক্ষেত্রে শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে প্রথম ধাপে সংশোধন করতে হয় পিতামাতার নাম। ভোগান্তিটা এখান থেকেই শুরু। অন্যদিকে শিশুর পিতা প্রবাসে থাকায় পাসপোর্টের নামের সঙ্গে অনেকের মিলছে না জন্মনিবন্ধনের নাম। এতে অভিভাবকদের আরেক ধাপ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া জন্মনিবন্ধন সংশোধনসহ নতুন জন্মনিবন্ধন করার জন্য আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা নাগরিকদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন।
বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ক্লান্ত চেহারায় হেঁটে যাচ্ছিলেন যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা হৃদয়। তিনি বলেন, আজকে ৫ দিন ধরে এই অফিসে ঘুরছি এনআইডি কার্ড করার জন্য জন্মনিবন্ধন করতে এসেছিলাম এখানে। একবার স্কুল সার্টিফিকেট লাগবে আবার তাদের কাছে গেলে বলে হোল্ডিং ট্যাক্স এর ফটোকপি লাগবে। সর্বশেষ বলছে আমার বাবা-মা’র জন্মনিবন্ধনের অনলাইন কপি লাগবে নাহলে হবে না। আজকে বাবা-মা’র জন্মনিবন্ধন নিয়ে এসেছি এখন বলছে- ডিসি অফিসে গিয়ে আবেদন কনফার্ম করে এই অফিসে আসতে। আমাদের সাধারণ মানুষকে নিয়ে তারা খেলছেন আর কিছুই না। আমার অফিস আছে অফিসে কয়দিন ছুটি নেয়া যায় দুইদিনের কাজ আজকে দশদিন লেগে যাচ্ছে।
সরকার নতুন করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করছে এখনো এনআইডি কার্ড করেনি মানিক নগর এলাকার বাসিন্দা সাদেক হোসেনের। এনআইডি কার্ড করার জন্য জন্মনিবন্ধন লাগবে। তিনি বলেন, আমি এখানে এসেছি জন্মনিবন্ধন করার জন্য আসার পর সবকিছু কাগজপত্র জমা দিয়েছি। চারদিন ধরে এইখানে ঘুরছি একদিন এক কাগজ চায় তারা। আজকে সব কাগজ জমা দিয়েছি এখন বলছে ডিসি অফিসে যেতে হবে ওইখানে সার্ভার থেকে আবেদন নিশ্চিত করে এখানে পাঠাতে হবে। এক কর্মকর্তা আমাকে অফার দিয়েছে যদি তাকে ৫০০ টাকা দেই তাহলে অফিসে যেতে হবে না উনারা এখান থেকে সব করে দেবেন। হয়রানি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে এসেছি।
সত্তুর বছরের বৃদ্ধা হালিমা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছেন এই অফিসের ১০৯ নম্বর রুমের সামনে। অফিস আর দোকান ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। তার মেয়ের জন্মনিবন্ধন সংশোধন করার জন্য এসেছিলেন এই কার্যালয়ে। আবেদনপত্র নিয়ে যাওয়ার পর দায়িত্বরত কর্মকর্তা এক একবার এক এক কাগজ চাচ্ছেন। একবার চাচ্ছেন বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি, একবার চাচ্ছেন পানির বিলের ফটোকপি দুই ঘণ্টা এই অফিস আর দোকানে আসা যাওয়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন আমি বৃদ্ধ মানুষ এই বয়সে কী এত হাঁটাহাঁটি করতে পারি উনারা একবারে বলে না কি কি লাগবে। সবকিছু দেয়ার পর এখন বলছে আসল জন্মনিবন্ধনের ফটোকপি লাগবে একবারে বলে দিলেই তো হতো এই বয়সে এত বার কি দৌড়াদৌড়ি করা যায়।
ন্যাশনাল কলেজের শিক্ষার্থী তারেক এসেছেন জন্মনিবন্ধন সংশোধন করার জন্য। তিনি বলেন, আজকে তিনবার পর্যন্ত এই আঞ্চলিক কার্যালয় আর ফটোকপির দোকানে আসা-যাওয়া করছি। উনারা একেকবার একেক কাগজপত্রের জন্য পাঠায়। এখানে আসার পর আমাকে বললো যে, বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি লাগবে আর গ্যাস বিলের ফটোকপি লাগবে, কিন্তু আমি বিদ্যুৎ বিল এবং গ্যাস বিলের ফটোকপি আনার পরে বলছে হোল্ডিং ট্যাক্সের ফটোকপি লাগবে। সবকিছু জমা দেয়ার পর এখন বলছে- হলফনামা লাগবে।