সরকারের নিবিড় তদারকিতে কন্টেইনার কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড : জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম ৪দিন থেকে নেমে একদিনে : আর্থিক প্রবৃদ্ধি ৩৭.৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে
দারুণ কর্মচঞ্চল দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দর। সরকারের নিবিড় তদারকিতে বেড়েই চলেছে কার্গো ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং। বন্দরের প্রতিটি সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখি। আমদানি-রফতানি পণ্য উঠা-নামায় রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আর্থিক প্রবৃদ্ধি ৩৭.৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বন্দরে জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম চারদিন থেকে নেমে একদিনে এসে দাঁড়িয়েছে। সক্ষমতার নতুন উচ্চতায় দেশের এই প্রধান সমুদ্রবন্দর। ফলে দেশের সার্বিক আমদানি-রফতানি তথা অর্থনৈতিক কর্মকাÐ কর্মমুখর হয়ে উঠেছে।
পতিত স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের সীমাহীন লুটপাট আর অর্থপাচারে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সচল করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রাম বন্দরকে সার্বক্ষণিক সচল রাখা। নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেনের নিবিড় তদারকি আর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের নিরলস প্রচেষ্টায় সক্ষমতার নতুন উচ্চতায় উঠে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দর পুরোদমে সচল হওয়ায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম গতিশীল হয়েছে। তাতে দারুণ খুশি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা। পবিত্র মাহে রমজানকে ঘিরে আমদানি বেড়েছে। বেড়েছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও। এসব আমদানি পণ্য দ্রæত খালাসের ব্যবস্থা নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। নানা অজুহাতে বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য থমকে দেওয়ার যে কোনো অপচেষ্টা রুখে দেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে এখন আর জাহাজ জট নেই। বড় বড় জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারছে। জেটিতে আসার জন্য এখন আর বিদেশি জাহাজগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ায় জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম পূর্বের চার দিনের স্থলে বর্তমানে একদিনে নেমে এসেছে। বন্দরের জেটি, ইয়ার্ডের জঞ্জাল পরিস্কার করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকা আমদানিকৃত গাড়ি এবং নিলামযোগ্য কন্টেইনার সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বন্দরের ইয়ার্ডে বর্তমানে নিলামের জন্য প্রায় ১০ হাজার কন্টেইনার স্থিত আছে। যা বন্দরের মোট ধারণ ক্ষমতার প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।
বন্দরের গাড়ি রাখার শেডে নিলামের জন্য দীর্ঘদিনের পুরনো ২৯৭টি গাড়ি পড়েছিল। নৌপরিবহন উপদেষ্টা সম্প্রতি বন্দর পরিদর্শনকালে কার শেডের নিলামযোগ্য গাড়ি দ্রæত সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেন। ইতোমধ্যে অনেক গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, এইসব নিলামযোগ্য কন্টেইনার ও গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতির সূচক আরো এক এগিয়ে যাবে। বন্দরে পড়ে থাকা ধ্বংসযোগ্য ১৫২ টিইইউএস কন্টেইনারের মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৯টি কন্টেইনারের পণ্য ধ্বংস করা হয়েছে। বাকি কন্টেইনারের পণ্য ধ্বংস হলে ইয়ার্ড আরো বেশি জঞ্জালমুক্ত হবে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিকট নিলামযোগ্য ১০ হাজার ১৭৬ টিইইউএস কন্টেইনারের মধ্যে কাস্টম কর্তৃক ইনভেনটরিকৃত এক হাজার ২৭২ টিইইউএস কন্টেইনারের ৩৭টি নিলাম প্রাপককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি কন্টেইনার এভাবে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন বন্দরের ইয়ার্ড এবং টার্মিনালের জন্য ৪৯টি ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। বন্দরে এসে পৌঁছেছে ১২টি ইক্যুইপমেন্ট। এলসি খোলা হয়েছে ১৯টি ইক্যুইপমেন্টের। এছাড়া বন্দরে ভারী কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য লালদিয়া (উত্তর) এলাকায় একটি হেভি লিফট কার্গো জেটি নির্মাণ প্রকল্প চলমান রয়েছে।
এফসিএল কন্টেইনার বন্দরের অভ্যন্তরে খুলে ডেলিভারী দেওয়ার পরিবর্তে অফডক থেকে ডেলিভারির অনুমতি দেওয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় এক মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। যার মাধ্যমে সরকারের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি আয় হবে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত বর্জ্য অপসারণ এবং ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে সংরক্ষণ ড্রেজিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রায় ৮.৫ লাখ ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি আগামী জুনে সমাপ্ত হবে। ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসাবে জাইকার সহযোগিতায় মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটির ২য় সংশোধিত ডিপিপি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ক্রয় চুক্তি ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। সিভিল কার্যক্রমের চুক্তি অতিশিঘ্রই সম্পাদিত হবে এবং দ্রæত নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করা হবে।
বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, বিগত ২০১৩ সাল থেকে পরিকল্পনা করা হলেও গত ১১ বছর বে-টার্মিনাল প্রকল্পে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারা আশা করছেন আগামী কিছু দিনের মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হবে এবং এরপর বিশ্বব্যাংকের সাথে ঋণচুক্তির করে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে।
বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, নানা সঙ্কট আর প্রতিক‚লতার পরও চট্টগ্রাম বন্দরের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। বন্দরের প্রতিটি সূচকে অগ্রগতি হচ্ছে। গেল বছর বন্দরে রেকর্ড সংখ্যক কন্টেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে। বন্দরে ৩.২৫ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার, ১২৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্গো ও ৩৮৫৭টি জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে। বিগত ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৭.৪২ শতাংশ, কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ৩.১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গেল বছর রাজস্ব আয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫.৯৯ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় ২১.৩৯ শতাংশ বেশি। গেল বছর রাজস্ব উদ্বৃত্ত দুই হাজার ৯৪৮.৯৭ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় ৩৭.৬০ শতাংশ বেশি।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বেসরকারি খাতে পরিচালিত নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এখনো পুরোদমে চালু হয়নি। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান টার্মিনালগুলো ব্যবস্থাপনা করে সেবা দিয়ে চলেছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল পুরোদমে চালু হলে সামনে কন্টেইনার পরিবহন আরো বাড়বে।
সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮৭ শতাংশই আনা-নেওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে। পায়রা ও মোংলা বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া হয় ১৩ শতাংশ পণ্য। তবে কন্টেইনার পরিবহনের ৯৯ শতাংশই আনা নেওয়া হয় চট্টগাম বন্দর ব্যবহার করে। আর তাই চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতার উপর দেশের সার্বিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বন্দর সংশ্লিষ্ট সকলের সার্বিক প্রচেষ্টায় বন্দরের সব সূচকে অগ্রগতি হচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ইক্যুপমেন্ট সংযোজনের ফলে সক্ষমতা বেড়েছে। চলমান প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বন্দরের সক্ষমতা আরো বাড়বে।