কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ ও বিপুল পরিমান বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত শেখ আল আমিন ছিল আওয়ামী লীগের ‘জঙ্গি পুতুল’।
জঙ্গিবাদের নামে উলামায়ে কেরাম ও বিরোধী মত দমন করতে আল আমিনকে ব্যবহার করা হতো। সৃষ্টির নেপথ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস।
আল আমিনের বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। সে ও তার পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থক। বোমা বানাতে এক্সপার্ট হওয়ায় তার নাম হয়ে যায় বোমারু আল আমিন। এই নামের কারনে তাকে সিলেক্ট করা হয় জঙ্গি নাটকের প্রধান চরিত্র হিসেবে।
বিগত ফ্যাসিষ্ট সময়ে যখন প্রয়োজন পড়ত তখন আল আমিনকে ব্যবহার করা হতো। জঙ্গিবাদের নামে নাটক সাজিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হতো। সঙ্গে মামলায় শত শত উলামায়ে কেরাম ও বিরোধী মতের নাম জড়িয়ে দেয়া হতো। চলত ধরপাকর সহ নানা নির্যাতন। কিছুদিন পর তাপসের কলকাঠিতে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসত আল আমিন। আবার যখন প্রয়োজন পড়ত একই নাটক সাজানো হতো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা হয়। এর মধ্যে চারটি সন্ত্রাস বিরোধী আইনে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আল আমিন চার কক্ষের ওই মাদ্রাসা চালিয়ে যে টাকা পেতেন তা দিয়ে ভাড়াও পরিশোধ করা সম্ভব হতো না। অথচ তিনি সব সময় বিলাসী জীবনযাপন করতেন। প্রাইভেটকারে চলাফেরা করতেন।
গত শুক্রবার সকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় উম্মুল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। একতলা একটি ভবনের চারটি কক্ষের মধ্যে দুটি কক্ষে শিশুদের পড়ানো হতো। বাকি ১টি কক্ষে আল আমিন স্ত্রী ও ৩ সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। অপর কক্ষে সে বিপুল পরিমান বোমা তৈরির সরঞ্জাম মজুদ করেছিল। সেখান থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
বিস্ফোরণে মাদ্রাসার দুটি কক্ষের দেয়াল উড়ে গেছে। ছাদ ও বীমে ফাটল ধরেছে। ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে পাশের একটি আবাসিক ভবনের নিচ তলার দেয়ালে ফাটল ধরে।
বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আল আমিনকে প্রধান আসামী করে ৭ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৬/৭ জনকে আসামী করে মামলা করেছে।
ঘটনার পরপরই শেখ আল আমিন পালিয়ে যায়। পরে অভিযান চালিয়ে তার স্ত্রী আছিয়া খাতুন (২৮), আছিয়ার বড় ভাইয়ের স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার (৩০), শাহিন ওরফে আবু বকর ওরফে মূসা ওরফে ডিবা সুলতান (৩৮) ও তার স্ত্রী আসমানী ওরফে আসমা (৩৪), মো. আমিনুর রহমান ওরফে দর্জি আমিন (৫০), মো. শাফিয়ার রহমান ফকির (৩৬) ও আহসান উল্লাহ ওরফে আল আমিন নামে ৭ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে। ৭ আসামী বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে রয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, ২৫-৩০টি শিশু তিনবেলা এসে এখানে আরবি পড়ত, যাদের বয়স ১০-১১ বছরের মধ্যে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে এ ভবনে কোনো কার্যক্রম ছিল না। ঘটনার সময় মাদ্রাসা ছুটি থাকায় বাচ্চারা রক্ষা পেয়েছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালিক পারভীন বেগম বলেন, ২০২২ সালের প্রথম দিকে একতলা নির্মাণ করার পর অর্থের অভাবে নির্মাণকাজ থেমে যায়। পরে ওই বছর হারুনুর রশিদ নামে এক ব্যক্তি তার কাছে বাসাভাড়া নেওয়ার জন্য আসেন। তিনি প্রথমে ভাড়া দিতে রাজি হননি। পরে হারুনুর রশিদ তাকে বলেন, এখানে আমার বোন ও ভগ্নিপতি থাকবে এবং শিশুদের আরবি শিক্ষা দেবে। এতে আপনাদের সওয়াব হবে।
তিনি বলেন, সওয়াবের আশায় মাত্র ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় তাদের রুম দেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে এক মাসের ভাড়া অগ্রিম নেওয়া হয়। ওই সময় হারুনুর রশিদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে মৌখিক চুক্তিতে ভাড়া দেন।
পারভিন বেগম বলেন, প্রতি মাসের ২০ থেকে ২৫ তারিখে ভাড়া দিতেন। সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর ভাড়ার জন্য এসেছিলাম। তখন ভবনের ভেতরে কোথাও পুলিশ কর্তৃক উদ্ধারকৃত তরল পদার্থের ড্রাম দেখতে পাইনি। সম্ভবত এগুলো পরে আনা হয়েছে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তরিকুল ইসলাম বলেন, পলাতক আসামী শেখ আল আমিন তার স্ত্রীর বড় ভাই হারুনের মাধ্যমে ওই ভবনের চার রুম ভাড়া নিয়ে নিজেরা বসবাস করত এবং উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আরবি পড়াত।
শুক্রবার ওই মাদরাসার মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আসামী আল আমিনের রুম ও পাশের রুমের চারদিকের দেয়াল, ছাদের কিছু অংশ বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায় তার ছেলে উমায়ের (১০) ও আব্দুর রহমান (২) আহত হয়। আল আমিন তার আহত দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার পর দ্রুত পালিয়ে যায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বোমা তৈরীর বিপুল সরঞ্জাম জব্দ ও বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে। ধারণা করা হচ্ছে নাশকতা করার জন্য এগুলো মজুদ করছিল।