Image description

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘জেনারেশন-জেড’ বা জেন-জির নেতৃত্বে একের পর এক গণ-আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের দমনমূলক শাসনের পতন ঘটায়। তারও আগে ২০২২ সালে শ্রীলংকায় দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক ধসের বিরুদ্ধে তরুণদের নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলন রাজাপাকসে সরকারের পতন ঘটায়, যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশে জেন-জিদের অনুপ্রাণিত করে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নেপালে দুর্নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ তরুণরা সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। জেন-জি আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটেছে দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারেও। ইন্দোনেশিয়ায়ও চলতি বছর জেন-জিদের বৃহৎ গণপ্রতিবাদ দেখা গেছে। এছাড়া তিমুর-লেস্তে, ফিলিপাইন, কেনিয়া, মরক্কো, ক্যামেরুন, টোগো, মেক্সিকো, পেরু, বুলগেরিয়া, সার্বিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেন-জি নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ ও গণ-আন্দোলন দেখা গেছে। এসব আন্দোলনকে নীতিনির্ধারণ ও শাসন ব্যবস্থার জন্য সম্ভাব্য মোড় ফেরানো মুহূর্ত হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। যদিও বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতে, আশির দশকের শেষ দিকের বহু গণ-অভ্যুত্থানের মতো এবারকার জেন-জিদের বৃহৎ আন্দোলনগুলো প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারছে না। এমনকি প্রভাব বিস্তারের পথও তৈরি করতে পারছে না। বিশ্লেষকদের মতে, তরুণদের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে আপাতদৃষ্টিতে নানা পরিবর্তন ঘটলেও আন্দোলনের প্রধান নীতিগত লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়ন এখনো সীমিত। মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্নীতির অভিযোগ ও সামাজিক বৈষম্যের মতো যে বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে জনঅসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, সে কাঠামোগত সংকটগুলো অনেকাংশে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে পরিবর্তন আনবে এমন দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকদের মতে, জেন-জি আন্দোলনের এ ফলাফল অনেকটা যেন আরব বসন্তের মতোই। আরব বসন্তকে শুরুতে ধরা হয়েছিল যুগান্তকারী এক মাইলফলক। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, যে তিউনিসিয়াকে আরব বসন্তের একমাত্র ‘সাফল্য’ বলে মনে করা হতো, সেখানেও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। হার্ভার্ডের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী এরিকা চেনোওয়েথের মতে, যে বৈশিষ্ট্যগুলো নীতিগত পরিবর্তন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের জন্য জরুরি—এসব আন্দোলনে তার অনেকগুলোই অনুপস্থিত। আশির দশকে পোল্যান্ডের ‘সলিডারিটি’ আন্দোলন কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রপন্থী সংগ্রামের মতো সফল উদাহরণগুলো সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এক শক্তিশালী তৃণমূল নাগরিক প্লাটফর্ম গড়ে তুলেছিল। সে তুলনায় এখনকার অনলাইননির্ভর আন্দোলনগুলো দ্রুত বিস্তৃত হলেও টেকসই পরিবর্তন আনতে পারছে না। এমনকি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক রূপান্তরের জন্য যে ধরনের ধারাবাহিক নেতৃত্ব, আদর্শিক ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রয়োজন তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও হিমশিম খাচ্ছে। যার ফলে পুরনো শক্তিগুলো দ্রুতই শূন্যস্থান পূরণ করে নিচ্ছে। মৌলিক কাঠামোগত সংকটগুলো অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে।»

যেসব দেশে জেন-জি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছে, তার অধিকাংশে তরুণরাই জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের উপস্থিতি ও প্রভাব সবচেয়ে কম। এমনকি এসব দেশ দুর্নীতি তালিকায়ও শীর্ষে অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান গ্লোবস্ক্যানের এক বৈশ্বিক জরিপে দেখা যায়, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বেকারত্ব এবং শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ—এ চারটি সংকটকে সবচেয়ে বেশি ‘মারাত্মক’ বলে চিহ্নিত করেছে জেনারেশন-জেড। দুর্নীতিকে খুব গুরুতর সমস্যা মনে করে জেন-জি অংশগ্রহণকারীদের ৬৪ শতাংশ, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ৬২ শতাংশ, আর বেকারত্বকে অত্যন্ত গুরুতর সংকট হিসেবে দেখছে জেন-জির ৬০ শতাংশ মানুষ। জেনারেশন-জেড মূলত এসব সমস্যাকে ‘ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা’ হিসেবে দেখছে। আর এ গভীর হতাশা ও ক্ষোভই তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, প্রতিবাদী অবস্থান ও পরিবর্তনের দাবিকে আরো তীব্র করে তুলেছে, যা বহু দেশে গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের সামাজিক পটভূমি তৈরিতে প্রভাব ফেলেছে।

আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, জেন-জি আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের বিক্ষোভে দুর্নীতি, রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও অর্থনৈতিক কষ্টের মতো দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সংকটগুলো সামনে উঠে এসেছে। কিন্তু এসব আন্দোলনের প্রভাব ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাত্রা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশ্লেষকদের মতে, বিক্ষোভগুলো সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে কোনো কোনো দেশের সরকার কিছু দাবি মানতে বা নীতি সংশোধনে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়েছে। তবে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া চাপ সামলানোর প্রাথমিক পরিবর্তন। কাঠামোগত সংস্কার বা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির মতো ফলাফল এখনো প্রমাণের পর্যায়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়নি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জেন-জি আন্দোলনের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করতে ব্যবস্থা না নিলে সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরায় ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৬ সালেও জেন-জি আন্দোলন দেখা দিতে পারে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রভাব ফেলতে পারে। নিউইয়র্কভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’-এর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জশুয়া কারলান্টজিকের মতে, আগামী বছরেও বিভিন্ন দেশে জেন-জি আন্দোলন দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, ‘স্পষ্ট নীতিগত রোডম্যাপ না থাকলে এসব আন্দোলনের দাবিকে নীতিতে রূপান্তর করা, দল ও রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে ঢুকে কার্যকর নেতৃত্ব দেয়া—খুব কঠিন হয়ে পড়বে।’

চলতি বছর নেপালে জেন-জি নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে পতন ঘটে কে পি শর্মা অলি সরকারের। তবে তরুণদের দাবি অনুযায়ী, কাঠামোগত রাজনৈতিক সংস্কার এখনো সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীয় অংশ এখনো পুরনো রাজনৈতিক শ্রেণীর মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। অর্থনীতির দিক থেকে অনিশ্চয়তা ও চাপ বেড়েছে। অবকাঠামো ক্ষতির ফলে বিনিয়োগ আস্থা ও প্রবৃদ্ধিতে দৃশ্যমান চাপ পড়েছে। কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট, যেগুলো বিক্ষোভের পেছনে প্রধান কারণ ছিল, সেগুলোর উল্লেখযোগ্য উন্নতি নেই। সামাজিকভাবে তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হলেও তারা শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বা নির্বাচনী জোটে রূপ নিতে পারেনি। ফলে নেপালে জেন-জি আন্দোলন ‘সরকার বদলাতে’ প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু কাঠামোগত অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সে পরিবর্তন এখনো আংশিক।

মাদাগাস্কারে জেন-জি আন্দোলনের শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ, পানি আর জ্বালানি সংকট থেকে। লোডশেডিংবিরোধী প্রতিবাদ থেকে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়ে সরকারের পতন ঘটায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকার পরিবর্তন হলেও বিদ্যুৎ-পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি–ব্যবস্থাপনা ও গভীর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে এখনো বড় কাঠামোগত সংস্কার দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও খাদ্যের দামে চাপ, তরুণ বেকারত্ব আর বিনিয়োগ অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে পুরনো জায়গাতেই।

জেন-জি আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল আফ্রিকার আরেক দেশ মরক্কোতে। ‘জেন-জি ২১২’ নামে সংগঠিত এ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সংকোচন, নতুন কর চাপ, মূল্যস্ফীতি এবং সরকারি ব্যয় অগ্রাধিকারের প্রতি অসন্তোষ। চাপের মুখে সরকার কয়েকটি সামাজিক সহায়তা প্রকল্প ও স্কলারশিপ তহবিল পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দেয়, কিছু ভর্তুকি পুনঃস্থাপন করে। তবে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান ও কাঠামোগত দুর্নীতি–সংস্কারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এখনো সীমিত ও আংশিক।

বিভিন্ন দাবিতে চলতি বছর রাজপথে নামে ফিলিপাইনের তরুণরা। শিক্ষা ব্যয় সংকোচন, ছাত্র ঋণের চাপ, খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক এলিটদের স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয় তারা। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দাবি ছিল—দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা, জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বাস্তব নীতি এবং নীতিনির্ধারণে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। প্রতিবাদের চাপে সরকার কিছু সামাজিক সহায়তা ও স্কলারশিপ প্রোগ্রাম পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেয়, খাদ্যশস্য আমদানি ও ভর্তুকি ব্যবস্থার ওপর অডিট আলোচনা শুরু হয় এবং কয়েকটি দুর্নীতিসংক্রান্ত তদন্ত সক্রিয় হয়। তবে দেশটিতে দুর্নীতি দমনে কাঠামোগত সংস্কার এখনো সীমিত, মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ওপর চাপ রেখেছে, আর কর্মসংস্থানে ঘোষণামূলক উদ্যোগের তুলনায় বাস্তবায়ন নেই।

চলতি বছর ইন্দোনেশিয়ায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী, নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। তারা ‘১৭+’ নামের রূপান্তরমূলক দাবি উত্থাপন করে, যা ছিল দুর্নীতি দমন, কর ও পার্লামেন্ট সদস্যদের সুবিধা পুনর্বিবেচনা, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার, জীবনযাত্রার ব্যয় ও ন্যূনতম মজুরি, রাজনৈতিক জবাবদিহি ও মানবাধিকার-সংক্রান্ত ১৭টি স্বল্পমেয়াদি এবং আটটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা। এর মধ্যে চাপের মুখে সরকার পার্লামেন্ট সদস্যদের বাড়তি সুবিধা বাতিল এবং বিদেশ ভ্রমণের কড়াকড়ি আরোপ করে কেবল। আন্দোলনের মূল কাঠামোগত ও দীর্ঘমেয়াদি দাবিগুলোর বাস্তবায়ন এখনো হয়নি।

আফ্রিকার আরেক দেশ কেনিয়ায় যে জেন-জি–কেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার কেন্দ্রে ছিল নতুন কর আইন, জ্বালানির ওপর কর বৃদ্ধি, ডিজিটাল সেবা ও ভ্যাট–চাপ, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা–সংকটের অভিযোগ। আন্দোলনের চাপের মুখে সরকার ফাইন্যান্স বিলের কয়েকটি ধারা বাতিল বা স্থগিত করে, জ্বালানি ও কিছু কর ব্যবস্থায় পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দেয় এবং কয়েকটি দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগে তদন্ত প্রক্রিয়া সক্রিয় করে। তবে বাস্তব চিত্র বলছে, তরুণদের চারটি মুখ্য দাবির বাস্তব অগ্রগতি এখনো আংশিক—মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপণ্যের দামে চাপ পুরোপুরি কমেনি, ফরমাল সেক্টরে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সীমিত, আর দুর্নীতি দমন ও বাজেট স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে কাঠামোগত ও স্থায়ী সংস্কার এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ছোট দেশ তিমুর-লেস্তেতেও ২০২৫ সালে জেন-জি-কেন্দ্রিক তরুণ আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল। যেখানে মূল ইস্যু ছিল সরকারি ব্যয়, সংসদ সদস্যদের সুবিধা, শিক্ষা-খাতে বরাদ্দ এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের চাপ। বিক্ষোভের চাপের মুখে সংসদ সদস্যদের কিছু বিদেশ ভ্রমণ কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করা হয়, বিতর্কিত কিছু ভাতা ও বরাদ্দ পুনর্বিবেচনার ঘোষণা আসে এবং বাজেট আইটেমগুলোর ওপর অডিট ও ব্যাখ্যার আলোচনাও তীব্র হয়। তবে তরুণদের বৃহত্তর দাবি কাঠামোগত দুর্নীতি-সংস্কার, কর্মসংস্থানমুখী নীতি পরিবর্তন ও সামাজিক খাতে স্থায়ী বিনিয়োগ বৃদ্ধির অগ্রগতি এখনো প্রতিশ্রুতি ও পুনর্মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়ে গেছে। জেন-জি আন্দোলন দেখা গেছে লাতিন আমেরিকায়ও। পেরু, চিলি ও কলম্বিয়ায় তরুণরা দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, সামাজিক অসমতা, পেনশন ও সরকারি নীতি সরকারকে সরাসরি চাপের মুখে ফেলে। তবে এসব দেশেও বাস্তব নীতিপরিবর্তনের পরিধি সীমিত।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তরুণরা শেখ হাসিনার ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর আনন্দে ফেটে পড়েছিল। হাসিনার পতনের পর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আগের শাসন ব্যবস্থার পতন হলো, তাদের অনেকের দৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পুনর্গঠনে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে পারেনি।

জেন-জি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়া দেশগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম শ্রীলংকা। দুর্নীতি, ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের গণ-আন্দোলন রাজাপাকসে পরিবারের দুই দশকের ‘একচেটিয়া’ রাজনীতির অবসান ঘটায়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার অর্থমন্ত্রী ভাই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্টির নেতা অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। এ দলটি ২০১৯ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। শ্রীলংকা অর্থনীতি এখন অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের নির্বাচন ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা অন্য দেশের জেন-জেড আন্দোলনের তুলনায় একেবারেই আলাদা ফল দেখাচ্ছে। প্রেসিডেন্সির ক্ষমতা কমানো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের পথে। বিশ্লেষকদের মতে, এশিয়ার নানা দেশে উঠে দাঁড়ানো জেন-জি তরুণদের জন্য শ্রীলংকা এ অভিজ্ঞতা শক্তিশালী পাঠের দাবি রাখে।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের এশিয়া ও বৈশ্বিক রাজনীতি বিষয়ক লেখক ও সম্পাদক ক্লারা ফং বলেন, ‘তরুণদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ফলাফল কিন্তু সবখানে একরকম নয়। কোথাও কোথাও (যেমন বাংলাদেশ বা নেপাল) বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই উল্টে দিতে পেরেছে তরুণরা। আবার অন্য জায়গায় (যেমন ইন্দোনেশিয়ায়) দীর্ঘদিনের ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলোর ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। অনেক শাসকই বিতর্কিত নীতি বা আইনের কিছু অংশ বাতিল করেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বরখাস্ত করেছে এবং একই সঙ্গে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভ দমন করেছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে এ আন্দোলনের চাপে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে, এ সরকারগুলো আদৌ কি দীর্ঘস্থায়ী এমন সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারবে, যা বিক্ষোভকারীদের মূল আক্ষেপ ও সংকটগুলো দূর করবে?’