অবেশেষে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর নির্বাসন থেকে দেশে ফিরলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এবং চর্চিত ওয়ান ইলেভেন বা ১/১১‘র সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের বিশেষ সরকারের সময় তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন।
গ্রেফতারের সময় তারেক ছিলেন সুস্থ ও স্বাভাবিক ৪২ বছরের একজন তারুণ্যদীপ্ত যুবক। কিন্তু কারাগারে যাওয়ার পর তাকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। আটকের পর একে একে তার নামে বিভিন্ন অভিযোগে ৮টি মামলা দায়ের করা হয়। সেই সব মামলায় রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয় বলে আদালতে অভিযোগ করেন তার আইনজীবী ও তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। এরপর এ্যাম্বুলেন্স ও ট্রেচারে করেও তাকে বিভিন্ন মামলায় আদালতে উপস্থাপন করা হত।
অবশেষে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আদালত তাকে জামিন দেয়। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান ও একমাত্র কন্যা জায়মা রহমানকে নিয়ে তিনি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডন চলে যান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে না গেলেও তখনকার সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার মাধ্যমেই তারেক রহমান মুক্তি পেয়েছিলেন বলে প্রচার রয়েছে।
সেই থেকে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর যাবত তারেক রহমান লন্ডনে ILR ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন (স্থায়ীভাবে বসবাস করার বৈধ অনুমতি) স্ট্যাটাসে বসবাস করেন। অবশেষে ২৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর পর দেশের মাটিতে ফিরলেন দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র আগামীর নেতৃত্ব তারেক রহমান।
১৯৮৮ সালে তারেক রহমান পিতৃজেলা বগুড়ার গাবতলী উপজেলা সদস্য হিসেবে নিজেকে পিতা দেশের সাবেক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর কয়েক বছরের মধ্যে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদ গ্রহণ করে দলীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখেন।
লন্ডনে দীর্ঘবছর নির্বাসিত থাকার পর তারেক রহমানের শেষ পর্যন্ত দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে তাকে ঘিরে বিএনপির ভেতরে ও বাইরে তৈরি হওয়া উদ্বেগের অবসান ঘটল।
তার দেশে ফেরার বাধা হিসেবে বিএনপি অনেক আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারকে বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরলেন সেই আওয়ামী সরকারের পতনেরও পনেরো মাস পর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমান তার দেশে ফেরার বিষয়ে নিজেই যে উদ্বেগ তৈরি করেছিলেন, তার অবসান ঘটিয়ে দেশে ফেরাটা তার দলের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের কাছে অনেকটা ‘ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো’, যা দলের জন্য স্বস্তি বয়ে নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন তারা।
তারেকের দেশে ফেরার মাধ্যমে সাবেক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংগঠিত ও জনপ্রিয় হওয়ার পর আবার একটি সমস্যা-সঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে তাদের জ্যেষ্ঠ সন্তানের সরাসরি নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ার সময়ে পদার্পণ করলো।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো তারেক রহমান ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দলকে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি নিজের রাজনৈতিক জীবনে এবারই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান তারেক রহমান ১৯৬৫ সালের ২০শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে করে আশির দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন কি-না সেই সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিএনপির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তারেক রহমান তার মায়ের সাথে রাজপথের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং ওই সময় ১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির গাবতলী উপজেলা ইউনিটের সদস্য হিসেবে তিনি আনুষ্ঠানিক বিএনপিতে সক্রিয় হন।
বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমান সক্রিয়তার পাশাপাশি জোরালো প্রভাব শুরু হয় ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। ওই নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। পরে ২০০২ সালের ২২শে জুন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ তৈরি করে তাকে ওই পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে হাওয়া ভবন নেয়া হয়েছিলো নির্বাচনী অফিস হিসেবে ব্যবহার করে প্রচার প্রচারণা চালানো ও নির্বাচনী কৌশল নিয়ে কাজ করার জন্য, যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তারেক রহমান। নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার হলো। কিন্তু হাওয়া ভবন থেকে গেলো এবং এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলো। এরপর ওয়ান ইলেভেনের পর গ্রেফতার, নির্যাতন ও কারাভোগ শেষে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হলো।
অবশ্য দলীয় রাজনীতিতে প্রভাববিস্তারের পাশাপাশি তারেক রহমান বিএনপির সংগঠন গোছানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং দলের তৃণমূলে ব্যাপক যোগাযোগ তৈরি করেন। এরপর ২০০৯ সালে দলের সম্মেলনে তাকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরপরই তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করে বিএনপি।
বিএনপির রাজনীতিতে এটা পরিষ্কার যে, মা খালেদা জিয়ার পর তারেক রহমানই হবেন দলের পরবর্তি চেয়ারম্যান।