আর এক মাস পরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক কর্মসূচি, পাল্টাপাল্টি মিছিল, সহিংস সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনি মাঠ। তফসিল ঘোষণার পরদিনই প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি। এছাড়া সম্প্রতি ঘটেছে আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড। এসব ঘটনার পর থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
এ অবস্থায় দুদিন পরই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের পবিত্র বড়দিন উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একই দিন দেশে ফিরছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডনে দীর্ঘ ১৭ বছরের প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরছেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা। এরপর রয়েছে থার্টিফার্স্ট নাইট উৎসব। পাশাপাশি কারামুক্ত হয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। এসব কারণে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘোলাটে পরিস্থিতির আশঙ্কা বাড়ছে জনমনে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, তফসিল ঘোষণার পর টার্গেট কিলিং, মবোক্রেসি ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো আতঙ্কজনক। নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতার ঝুঁকিও বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি।
তবে পুলিশ বলছে, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত। মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে পুলিশ কমিশনার, এসপি, ডিসি, বিভাগীয় কমিশনার ও ডিআইজিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অপরাধ দমনে নিয়মিত অভিযান চলছে। কারামুক্ত সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট। এ উপলক্ষে গত ১১ ডিসেম্বর ঘোষিত হয় নির্বাচনি তফসিল। এর পরদিনই রাজধানীতে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি। তিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হলে ১৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি মারা যান। এ ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। হামলার শিকার হয় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও। এসব ঘটনায় নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থী ও রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা আরও বেড়েছে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়া নিয়েও।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১১ জন করে মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেন। ৫ আগস্টের আগে ও পরে বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া এক হাজার ৩০০-এর বেশি অস্ত্র ও আড়াই লাখেরও বেশি গোলাবারুদ এখনও উদ্ধার হয়নি। একই সময়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন অন্তত ১২ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। এদের মধ্যে রয়েছে সুইডেন আসলাম, কিলার আব্বাস, ফ্রিডম রাসু, পিচ্চি হেলাল ও ইমন। মুক্তির পর রাজধানীতে হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ১৩ জন শীর্ষ জঙ্গি এখনও পলাতক।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মনিরুজ্জামানের মতে, এসব ঘটনাপ্রবাহ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি ঘোলাটে পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি বলেন, “সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নতুন করে সমীক্ষা করা প্রয়োজন। যেসব প্রার্থী বা রাজনৈতিক নেতা হুমকির মুখে রয়েছেন, প্রয়োজনে তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।”
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সহিংসতা, টার্গেট কিলিং ও মবোক্রেসির ঘটনাগুলো আতঙ্কের। এগুলো নির্বাচন, রাজনীতি এবং চলমান সহনশীলতার ক্ষেত্রে অস্থিরতার পূর্ব সংকেত। কারণ দেশে আইনবহির্ভূত ঘটনা বেড়েছে। পাশাপাশি, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কারামুক্তির বিষয়টি উদ্বেগজনক। নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতার আশঙ্কাও প্রবল হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবির জায়গায় জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা অনেক সময় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে দোদুল্যমান থাকেন এবং সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়লে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা কমে আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টি হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা করে প্রয়োগযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে পারলেই রাজনৈতিক সহিংসতা কমবে।”
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, “সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক টহল দল মাঠে কাজ করছে। সহিংসতা ও নাশকতার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “সামনে বড়দিন ও থার্টি ফার্স্ট নাইট রয়েছে। পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশ পুরোপুরি প্রস্তুত। ইতোমধ্যে পুলিশের প্রতিটি ইউনিট চেকপোস্ট কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও সন্দেহভাজন অপরাধীদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “আজ (মঙ্গলবার) সচিবালয়ে পুলিশ কমিশনার, এসপি, ডিসি, বিভাগীয় কমিশনার ও ডিআইজিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোর দেওয়া হয়েছে।”
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া সন্ত্রাসীদের বিষয়েও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। যারা আবার অপরাধে জড়ানোর সন্দেহভাজন, তাদের পুনরায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রার্থীদের গুরুত্ব অনুযায়ী নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তবে এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে জানা যাবে কারা চূড়ান্ত প্রার্থী হচ্ছেন। এরপর সেই অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আসন্ন বড়দিন ও থার্টি ফার্স্ট নাইট ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযান চলছে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একইসঙ্গে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও কঠোর নিরাপত্তা ছক তৈরি করা হয়েছে।”