বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, অডিট আপত্তি দুর্নীতি নয়। এটা একটা প্রশাসনিক বিষয়। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু এর আগেই অডিট আপত্তিকে দুর্নীতি হিসেবে চালিয়ে দেয় অনেক গণমাধ্যম। এতে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন সংশ্লিষ্টরা। সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সংবাদ সম্মেলন ও সংলাপে এ কথা বলেন তিনি।
মনির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর মূল ভিত্তি হলো আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও মানবিক মর্যাদা। এই কাঠামোর ভেতরেই বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি বিশেষায়িত কারিগরি ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের অর্থনীতি, যোগাযোগ ও জাতীয় নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকারি কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য অডিট বা নিরীক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অডিটের উদ্দেশ্য কখনোই কাউকে অপরাধী বানানো নয়; বরং এটি একটি প্রতিরোধমূলক ও নিয়ন্ত্রণমূলক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি- অডিট আপত্তি উঠলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘দুর্নীতিবাজ’, ‘লুটপাটকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কোনো তদন্ত, চার্জশিট বা আদালতের রায় ছাড়াই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে চরিত্রহনন করা হচ্ছে। এর সরাসরি শিকার হচ্ছেন তাদের পরিবার, সন্তান ও পোষ্যরা- যারা সামাজিক নিগ্রহ, মানসিক চাপ ও সম্মানহানির মধ্যে পড়ছেন। এটি কেবল প্রশাসনিক অনিয়ম নয়, সংবিধান লঙ্ঘন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির পরিপন্থি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সোসাইটির সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনিরের সভাপতিত্বে সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ে জাতীয়তাবাদী রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী দলের সাধারণ সম্পাদক এড. এম আর মনজু, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ে কারিগর পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এস কে বারী।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, অডিট আপত্তি মানেই দুর্নীতি নয়। রেলওয়ের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অডিট আপত্তির বাস্তব চিত্র তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৯টি অডিট আপত্তির মধ্যে ৫টি নিষ্পত্তি হয়েছে দুর্নীতির প্রমাণ ছাড়াই। বাকিগুলো নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াধীন। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পে ১৬টি অডিট আপত্তির সবগুলোই নিষ্পত্তি হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াই। আখাউড়া-লাকসাম দ্বৈতগেজ প্রকল্পে ১২টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি। এডিবি অর্থায়নে বগি ক্রয় প্রকল্পে ২টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে (রাজশাহী জোন) ২০টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি। ২০১৬-১৭ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ১৫০টি অডিট আপত্তির মধ্যে ৪৯টি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ১০১টি প্রক্রিয়াধীন। এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে অডিট আপত্তি প্রশাসনিক বিষয়, অপরাধ নয়।
সংলাপ ও সংবাদ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হলো- অডিট আপত্তি ও দুর্নীতির মধ্যে আইনি পার্থক্য স্পষ্ট করা; তদন্তের পূর্বেই কাউকে অপরাধী বানানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া; বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের সামাজিক মর্যাদা ও মানবাধিকার রক্ষা করা।
আইনগতভাবে অডিট ও অডিট আপত্তির প্রকৃত অবস্থান: আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অডিট বলতে বোঝায়- সরকারি অর্থ সঠিক খাতে ব্যয় হয়েছে কি না, নথিপত্রে কোনো অসঙ্গতি আছে কি না, বিধি-বিধান অনুসরণ করা হয়েছে কি না। অডিট আপত্তি হলো- একটি প্রশ্ন, একটি পর্যবেক্ষণ, একটি ব্যাখ্যা দাবি। এটি কোনোভাবেই- অপরাধের প্রমাণ নয়, দুর্নীতির স্বীকৃতি নয়; কিংবা শাস্তির ভিত্তি নয়। বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, সরকারি আর্থিক বিধি, দণ্ডবিধি, দুদক আইন- সবখানেই স্পষ্টভাবে বলা আছে তদন্ত, অভিযোগপত্র ও বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।
সাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন: বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- অনুচ্ছেদ ৩১: আইনের আশ্রয় ও ন্যায়বিচারের অধিকার। অনুচ্ছেদ ৩২: জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার। অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের দৃষ্টিতে সমতা। অনুচ্ছেদ ২৮: মানবিক মর্যাদা। এছাড়া হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের একাধিক রায়ে বলা হয়েছে- তদন্ত ছাড়া অপসারণ, চাকরিচ্যুতি বা বাধ্যতামূলক অবসর প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার ও অবৈধ। আইএলও কনভেনশন ১৫৮ অনুযায়ী- উপযুক্ত কারণ ও ন্যায্য প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো কর্মীকে বরখাস্ত করা যাবে না।
অডিট আপত্তিকে ‘দুর্নীতি’ বলে চালিয়ে দেওয়া প্রশাসনিক নাকি রাজনৈতিক কৌশল: অডিট আপত্তিকে ‘দুর্নীতি’ বলে প্রচার করা হচ্ছে? এটি কি কোনো পছন্দসই বা সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরক নিয়োগ দেওয়ার জন্য একটি পরিকল্পিত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কৌশল? বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক, এডিজি, জিএম, চীফ, ডিআরএম, বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কারিগরি দায়িত্বশীল পদের কর্মচারীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো কি এখন রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নের টার্গেটে পরিণত হয়েছে? প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব এখন কি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের শিকার? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিলে আমরা প্রজাতন্ত্রের সেবকদের একটি অস্থির, শঙ্কিত ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশে ঠেলে দিচ্ছি, পেশাদারিত্ব,
নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নে প্রশাসন যদি রাজনৈতিক খেলার মাঠে পরিণত হয় তবে তার চূড়ান্ত ক্ষতি ভোগ করবে রাষ্ট্র ও জনগণ।
রেলওয়ে নেতৃত্ব রাজনৈতিক নয়, পেশাগত দক্ষতার প্রশ্ন: বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি বিশেষায়িত কারিগরি ও ভারী অবকাঠামোগত সংস্থা। এখানে নেতৃত্ব মানে- দীর্ঘ পেশাগত অভিজ্ঞতা, কারিগরি ও প্রশাসনিক দক্ষতা, নীতিনির্ধারণে প্রাজ্ঞতা, জটিল অবকাঠামো পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। একটি অডিট আপত্তিকে কেন্দ্র করে যদি কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে চলমান প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ভয় ও অনাস্থা সৃষ্টি হবে, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। বাংলাদেশ রেলওয়েতে যদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বা প্রশাসনিক আধিপত্য কায়েম করা হয়, তবে রেলওয়ে সুষ্ঠু পরিচালনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান: গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো- বিচার নয়, তথ্য উপস্থাপন। চরিত্রহনন নয়, সত্য যাচাই। মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, জনস্বার্থ রক্ষা। অডিট আপত্তিকে দুর্নীতি হিসেবে উপস্থাপন করা হলে তা আদালতের এখতিয়ার লঙ্ঘন করে, ন্যায়বিচার ব্যাহত করে এবং পুরো প্রশাসনিক কাঠামোকে ভীত ও অস্থিতিশীল করে তোলে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির দৃঢ় অবস্থান: বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছে- অডিট আপত্তি দুর্নীতির প্রমাণ নয়। আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো শাস্তি গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া হবে। দক্ষ নেতৃত্বের স্থিতি মানেই রেলওয়ের স্থিতি। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে-কিন্তু সংবিধান, আইন ও ন্যায়বিচারের আলোকে।