Image description

জুলাই অভ্যুত্থানে শত শত ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন হাজার হাজার। এদের কাঁধে ভর করেই তরুণ ছাত্রনেতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। উপদেষ্টার চেয়ারে বসেই নিজের আখের গোছানোর ধান্দায় নেমে পড়েন তিনি, যা জুলাই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ও আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই নয়। ঘুষ-দুর্নীতি ও ধান্দার সুবিধার জন্য শুরু থেকেই তদবির করতে থাকেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হওয়ার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আনুকূল্যে অবশেষে তিন মাসের মাথায় পেয়েও যান। সেই থেকে গত ১০ ডিসেম্বর পদত্যাগ পর্যন্ত ১৩ মাস ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এছাড়া উপদেষ্টা পদে মোট মেয়াদ ছিল তার ১৬ মাস। এত অল্প সময়ে আসিফ মাহমুদ যেসব অনিয়ম-অপকর্ম করেছেন তাতে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

শুরুতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের দুর্নীতি-অনিয়মের কিছুটা রাখঢাক থাকলেও এক পর্যায়ে সবকিছুই ‘ওপেন’ হয়ে যায়। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে প্রকাশ্যেই ঘুষ লেনদেন চালু করেন তিনি। ঘুষ লেনদেনের সুবিধার জন্য সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর সঙ্গে যোগসাজশে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেন এ মন্ত্রণালয়ে। উপদেষ্টা পদে আসিফ মাহমুদ বর্তমানে না থাকলেও সিন্ডিকেট বহাল-তবিয়তেই রয়েছে এবং এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সচিব জাহেদী। বরং নতুন উদ্যমে সিন্ডিকেট তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

উপদেষ্টা পদে থাকাকালে এতোদিন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ‘ডানহাত’ হিসেবে ছিলেন মো. আবুল হাসান। আসিফ মাহমুদ পদত্যাগের প্রাক্কালে এই আবুল হাসানকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদে পদায়নের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তাকে সবচেয়ে ব্যস্ত, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ডেস্ক- নগর উন্নয়ন অধিশাখা-২ দিয়েছেন সচিব রেজাউল মাকসুদ জাহেদী, যে অধিশাখা থেকে পরিচালিত হয়ে থাকে দেশের ৩৩০টি পৌরসভা। দেশের অধিকাংশ সংসদীয় নির্বাচনী আসন এই পৌরসভাগুলোর অধীনে পৌরসভাগুলোর বাজেট বরাদ্দ, প্রকৌশলী বদলি-পদায়নসহ সকল কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত-পরিচালিত হয়ে থাকে মন্ত্রণালয়ের এই অধিশাখা থেকে। আবুল হাসানকে এই ডেস্কে পদায়নের পেছনে ঘুষ লেনদেন ছাড়াও নির্বাচনকে প্রভাবিত করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও নিহিত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

আবুল হাসান ছাড়াও সচিব জাহেদীর নেতৃত্বাধীন এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী, যারা আওয়ামী লীগ আমলে ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার দায়ে অভিযুক্ত। পিএস পদে থেকে মূলতঃ আবুল হাসানই নিজের বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা হাসিল করার জন্য আওয়ামী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে সহায়তাও করেছেন। বলা যায়, উপদেষ্টা ও সচিবের নেতৃত্বাধীন এই সিন্ডিকেট তৈরিতে মূল ভূমিকা রেখেছেন আবুল হাসানই। গত বছরের নভেম্বরে আসিফ মাহমুদ যখন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ওই সময় নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় মো. নিজাম উদ্দিনকে। এর আগে পদটি শূন্য ছিল। নিজাম উদ্দিনের পদায়নের ব্যবস্থা করেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদই এবং এ বাবদ তিনি বড় অংকের অর্থও আদায় করে নেন। পরবর্তীতে নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব বেধে যাওয়ায় তাকে সরিয়ে রেজাউল মাকছুদ জাহেদীকে পদায়নের ব্যবস্থা করেন। জাহেদী ওই সময় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে অর্থাৎ আসিফ মাহমুদের অধীনেই ছিলেন। জাহেদীর সঙ্গে লেনদেনের ভাগবাটোয়ারায় ‘বোঝাপড়া’ ভালোই চলছিল। তাই পছন্দ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আনেন। অবশ্য এক্ষেত্রে মূল সমর্থন ছিলো তখনকার পিএস আবুল হাসানেরই। ছাত্রজীবনে রেজাউল মাকছুদ জাহেদী নাকি ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে ছিলেন। আবুল হাসানও তাই। এখন অবশ্য উভয়েই শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। জাহেদী জয়-পলকের দুর্নীতির সহযোগী এবং আওয়ামী ফ্যাসিস্ট হিসেবে আগে থেকেই চিহ্নিত আছেন।
এই চক্রটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আওয়ামী পুনর্বাসন কেন্দ্র বানিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এবং ডিএসসিসির প্রশাসক মাহমুদুল হাসান, উপসচিব আকবর হোসেন, যুগ্মসচিব ড. মনিরুল ইসলাম। উপসচিব আকবর হোসেনের বাবা সাতক্ষীরা জেলা কৃষক লীগের অন্যতম সহসভাপতি। এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গঠিত নতুন কমিটিতেও তিনি কৃষক লীগের ওই পদে বহাল আছেন। উপসচিব আকবর হোসেন নিজ দপ্তরের অতিরিক্ত হিসেবে অঘোষিতভাবে দায়িত্বে ছিলেন সচিবের দপ্তরের সকল নথি পর্যবেক্ষণ করে দেখার। আকবর হোসেনের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া কোনো নথিই স্থানীয় সরকার সচিবের টেবিলে যেতো না। পিএস আবুল হাসানই তাকে অঘোষিত এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। গত ১৫ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আকবর হোসেনকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বদলি করেছে। কিন্তু এর আগেও একাধিকবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তার বদলির আদেশ জারি করলেও কার্যকর করা যায়নি তখনকার পিএস আবুল হাসানের তদবিরের কারণে।

অতিরিক্তি সচিব মাহমুদুল হাসান আওয়ামী সুবিধাভোগী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি আওয়ামী লীগ আমলে দুই জেলার ডিসি ছিলেন। এরপরে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে প্রাইজ পোস্টিং নেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসে। ডিসি পদে থেকে আওয়ামী ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠার পুরস্কার হিসেবেই তিনি এ পদায়ন পান। বর্তমানে তাঁর ওএসডি থাকার কথা। কিন্তু আবুল হাসানই তাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে রেখেছেন এবং মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইংয়ের দায়িত্বে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। শুধু তাই নয়, গত ৩ নভেম্বর থেকে একই সঙ্গে তাকে ডিএসসিসির প্রশাসক পদেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
যুগ্মসচিব ড. মনিরুল ইসলাম আওয়ামী কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশে একাধিকবার শিক্ষা ছুটির সুযোগ ভোগ করেছেন ওই আমলে। সর্বশেষ তিনি ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এক নাগাড়ে সাড়ে চার বছর শিক্ষা ছুটির নামে বিদেশে কাটিয়েছেন। এর আগে ২০১৫ সালেও প্রেষণে এক বছরের শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলের শেষের দিকে ফ্যাসিস্ট মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিশেষ পছন্দে তিনি এ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন পান। ৫ আগস্ট, ২০২৪ এর পর তৎকালীন দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিস্ট সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে (বর্তমানে যিনি শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি মামলার আসামী) ম্যানেজ করে। এরপরে তার আশ্রয়দাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন উপদেষ্টার পিএস আবুল হাসান।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল প্রকল্পেরই কর্ণধার হলেন পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক। ফ্যাসিস্ট মাহমুদুল হাসানকে এই পদে রেখে সবগুলো প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছেন আবুল হাসান। প্রতিটি প্রকল্প অনুমোদনের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে নির্দিষ্ট হারে কমিশন দিতে হয় এই চক্রকে। এছাড়া পিডি নিয়োগসহ প্রকল্পের ধাপে ধাপে নানা অনিয়ম-অপকর্ম তো আছেই।

শীর্ষনিউজ