ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি। যার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ, সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের প্রায় প্রতিটি স্তরেই রয়ে গেছে প্রশ্ন, কে এই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী? কারা বাস্তবায়নকারী? প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘাতকরা পালালো কীভাবে? আর এই মৃত্যু কি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার জীবন কেড়ে নিল, নাকি পুরো নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকেই অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিল? হত্যাকাণ্ড এবং পরের ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটির নেপথ্যে কী?
প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা: কী ঘটেছিল সেদিন
২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর দুপুর ২টা ২০ মিনিট। ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা শেষে জুমার নামাজ পড়েন। মসজিদ থেকে বের হয়ে একটি অটোরিকশায় ফিরছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। প্রত্যক্ষদর্শী ও সিসিটিভির ফুটেজ অনুযায়ী, একটি মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তি খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। মুহূর্তেই এলাকা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অস্ত্রোপচারের পর অবস্থার অবনতি হলে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর এবং পরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানেই কয়েক দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৮ ডিসেম্বর রাতে তার মৃত্যু হয়।
ওসমান হাদীকে হত্যার পরিকল্পনার ছক কষেছিলো আরো আগে। কখন, কোথায়, কীভাবে গুলি করে কোন রুট ধরে পালিয়ে যাবে, এর সবই ছিলো পূর্বনির্ধারিত। হামলাকারীরা ব্যস্ত রাজধানীতে হাদিকে গুলি করার পর শত শত সিসি ক্যামেরার চোঁখ ফাঁকি দিয়ে, পুলিশ চেকপোস্টকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অতি অল্প সময়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বর্ডার ক্রস করে ভারতে চলে গেলো। কীভাবে এত দ্রুত দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলো? এর পেছনে কাদের হাত রয়েছে? যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হত্যাকারীদের ভারত যাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করেনি। তবে একাধিক সূত্রে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, ফয়সাল করিম মাসুদ ও আলমগীর শেখ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে পালিয়ে গেছে। হাদিকে গুলি করার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা ঢাকা থেকে হালুয়াঘাটে পৌঁছাতে দুইবার প্রাইভেটকার বদল করে। পুলিশ যখন জানতে পারে, ততক্ষণে তারা কাটাতারের ওপারে। তবে গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, হাদিকে গুলি করার পর পালানোর জন্য তারা যে রুট ব্যবহার করেছিলো, তা দেখে অভিজ্ঞ গোয়েন্দারাও কপালে চোখ তুলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হামলার আগেই সীমান্ত পার হওয়ার সব লজিষ্টিক ব্যবস্থাই তারা করে রেখেছিলো। হামলার মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই তারা হালুয়াঘাট পৌঁছে যায়। পরে মানব পাচারকারীদের সহায়তায় তারা সীমান্ত পার হয় বলে প্রকাশিত তথ্যে দাবি করা হয়।
তদন্তের শুরু: শুটার চিহ্নিত, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রাথমিক ধারণা, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিতভাবে হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতার করা গেলে হামলার নেপথ্যের প্রকৃত কারণ এবং কারা এর সঙ্গে যুক্ত, তা স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানায়, একজন সন্দেহভাজনকে শনাক্ত এবং তাকে ধরতে অভিযান চলছে। তার বিষয়ে কোনো তথ্য পেলে পুলিশকে জানানোর অনুরোধ এবং তথ্যদাতাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী হামলাকারীদের ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন এবং এ ঘটনায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন।
ডিবি পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গুলি চালানো যুবকের নাম ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল ওরফে দাউদ খান। তিনি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাসিন্দা এবং রাজধানীর আদাবর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ফয়সাল ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আদাবরে একটি ডাকাতির ঘটনায় র্যাব তাকে গ্রেফতার করে এবং তার কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল, গুলি ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।
হামলায় জড়িত অপর ব্যক্তিকে এখনো নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। সম্ভাব্য তিনজনের ছবি নিয়ে প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ চলছে। এছাড়া হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে একজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্তকারীদের ধারণা, ঘটনার পর শুটার ও তার সহযোগী সীমান্ত এলাকার দিকে পালিয়ে যেতে পারে। এজন্য সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে এবং বিজিবিও কঠোর তৎপরতা চালাচ্ছে। ডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় তদন্তে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এক কর্মকর্তা বলেন, শুটার হিসেবে ফয়সাল করিম মাসুদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত এবং তাকে গ্রেফতারের খুব কাছাকাছি রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী- যদিও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ফয়সাল দেশে নেই। ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন শিকদার জানান, জড়িতদের ধরতে একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে এবং দ্রুতই অগ্রগতি আশা করা হচ্ছে।
‘সখ্যতা’ থেকে ‘শুটার’: সাত দিনের ভয়ংকর পরিকল্পনা
গোয়েন্দা তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। হত্যার আগে মাত্র সাত দিনের মধ্যে ওসমান হাদির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে ফয়সাল। নির্বাচনী প্রচারণা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত যাতায়াত, এমনকি হাদির টিমের অংশ হয়ে ওঠে সে। তদন্ত অনুযায়ী, ৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে প্রথম বৈঠকে ফয়সালকে দেখা যায়। নির্বাচনী পরিকল্পনা নিয়ে ৯ ডিসেম্বর আবারো আলোচনা করা হয়। ১২ ডিসেম্বর সেগুনবাগিচায় সরাসরি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে ফয়সাল। একই দিন দুপুরে হাদিকে বক্স কালভার্টে গুলি করে ফয়সাল। এই ধারাবাহিকতায়ই প্রশ্ন আসে, এতদিন অনুসরণ, রেকি ও পরিকল্পনার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কোথায় ছিল?
মাস্টারমাইন্ড কে? শাহীন চেয়ারম্যানের নাম কেন আসছে
জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা হাদি হত্যার মাস্টারমাইন্ডের নাম সামনে এসেছে। হত্যার নেপথ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ওরফে ‘শাহীন চেয়ারম্যানের নাম উঠে এসেছে। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, কিলিং মিশন বাস্তবায়নে অর্থ এবং অস্ত্রের মূল জোগানদাতা ছিলেন শাহীন নিজেই। এছাড়া চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডে শাহীন চেয়ারম্যানের সহযোগী হিসাবে আরও কয়েকজনের যোগসূত্রতা পেয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। যাদের কয়েকজন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতা। এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল একটি সূত্র।
সূত্র জানায়, শাহীন চেয়ারম্যান ছাড়াও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল হামিদকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হাদির ওপর হামলার পর ঘাতকদের ঢাকা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন এই হামিদ। জুলাই বিপ্লবে শরিফ ওসমান হাদির ভূমিকা এবং গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে তার বিভিন্ন বক্তব্য ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ চরম ক্ষুব্ধ ছিল। দলটি হাদিকে আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসরদের জন্য বড় বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করে। এরপর হিটলিস্টের প্রথম টার্গেট হিসাবে হাদিকে হত্যার ছক কষা হয়।
শাহীন আহমেদের পরিচয় শুধু একজন সাবেক জনপ্রতিনিধি নয়। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘মাফিয়া ডন’ হিসেবেও পরিচিত। দীর্ঘদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং একাধিক সন্ত্রাসী মামলার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের মতো শাহীন চেয়ারম্যানও সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যেতে সক্ষম হন। সেখানে পলাতক অবস্থায় তিনি দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকলেও গত ৩-৪ মাস থেকে খোলস ছেড়ে পুরোনো চেহারায় আবির্ভূত হন। সম্প্রতি তিনি দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের হিটলিস্ট প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন অ্যাপসে মুঠোফোনে দেশে থাকা স্লিপার সেলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ কল এবং খুদেবার্তার (এসএমএস) সূত্রে হাদি হত্যায় শাহীন চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ঘটনার আগে ও পরে কিলারদের সঙ্গে পলাতক ছাত্রলীগ নেতা হামিদের একাধিকবার যোগাযোগ করার প্রমাণও মিলেছে। এছাড়া ভারতে পলাতক থাকা আরও কয়েকটি গ্রুপ অ্যাপস ব্যবহার করে ঢাকায় জড়ো স্লিপার সেলের সদস্যদের কাজ সমন্বয় করছে। যাদের অনেকে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে চলে এসেছে।
সূত্র বলছে, হাদি হত্যা মামলার তদন্তে সন্দেহভাজনের তালিকায় কয়েকজন রাজনীতিকের নামও উঠে এসেছে। এ বিষয়ে আরও তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এজন্য গ্রেফতারকৃত আসামিদের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থার টিমসহ যৌথভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া পলাতক শাহীন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত কেরানীগঞ্জ জেলার দুজন ছাত্রলীগ নেতাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। শরিফ ওসমান হাদি হত্যা মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শফিকুল ইসলাম শুক্রবার বলেন, ‘আমরা সবদিক মাথায় রেখে তদন্ত করছি। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করা হচ্ছে। আশা করি খুব শিগগিরই এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ডসহ পরিকল্পনাকারীদের সবার নামই জানা সম্ভব হবে। তবে এখানেও প্রশ্ন- যদি এত গুরুতর অভিযোগ ও তথ্য থাকে, তাহলে এখনো কেন ওই পরিকল্পনাকারীরা গ্রেপ্তার বা প্রত্যর্পণের আওতায় আসেননি?
প্রশাসনের ব্যর্থতা ও চোখের সামনে পালিয়ে যাওয়া
হত্যার পর ফয়সাল ও তার সহযোগীদের পালানোর পথ যেন সিনেমার চিত্রনাট্যকে হার মানায়। একের পর এক যানবাহন পরিবর্তন, নকল নম্বরপ্লেট, সীমান্ত এলাকায় মানব পাচারকারীর সহায়তা, সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। তদন্তে জানা যায়, মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট বদলানো হয়, অস্ত্র ও আলামত বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়, পরিবারের সদস্যরাও পালাতে সহায়তা করেন, সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর প্রমাণও মিলেছে। এত কিছুর পর জনমনে প্রশ্ন রয়েই যায়, আগাম গোয়েন্দা তথ্য থাকা সত্ত্বেও কেন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি? ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডে সবাই যখন স্তব্ধ তখন, প্রবাসী এক ফেসবুক এক্টিভিষ্ট ও ইউটিউবারের তথ্যমতে, ঘাতক যখন গুলি ছোড়ে, সেসময় পেছনে দুটি সিএনজির ব্যাকআপ টিম ছিলো। যদি কোনো কারণে হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, তাহলে ধোঁয়া সৃষ্টি করে ঘাতককে সরিয়ে নেবে। এই হামলাকারীদের সেফ একজিট দেয়ার জন্য একটি বড় সংঘবদ্ধ দলও ছিল। প্রশ্ন হলো, দেশে ডজনখানেক গোয়েন্দা সংস্থা থাকতে এরা জানার আগে ইউটিউবারের কাছে এসব তথ্য কি করে পৌঁছালো?
মৃত্যুর পর দেশজুড়ে সহিংসতা: নেপথ্যে কী?
হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় শুরু হয় বিক্ষোভ। কিন্তু শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পাশাপাশি দেখা যায় ভয়াবহ সহিংসতা। ঢাকায় প্রথম আলো, ডেইলি স্টার অফিস, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন এলাকা, ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায়ও সংঘর্ষ ও ভাঙচুর হয়। প্রশ্ন উঠছে, এই সহিংসতা কি স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ, নাকি পরিকল্পিত উস্কানি? পুলিশ জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতে, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাই সহিংসতাকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি এসব হামলাকে ন্যাক্কারজনক ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছে। ১৯ ডিসেম্বর রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ অবস্থান তুলে ধরেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মির্জা ফখরুল বলেন, কাপুরুষোচিত এই হত্যাকাণ্ডের আমরা তীব্র ঘৃণা ও নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করছি।
তিনি দাবি করেন, এসব ঘটনা প্রমাণ করে একটি পুরোনো চিহ্নিত মহল দেশকে পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে চায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে তারা নস্যাৎ করে দেশে ফ্যাসিবাদের একটি নতুন সংস্করণ কায়েম করতে চায়। সরকারের নাকের ডগাতেই এই তৎপরতা চলমান। জনগণও মনে করে, এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। এর ফলে দেশ-বিদেশে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেন, হাদি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইতোমধ্যে দেশের সব রাজনৈতিক দল হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে এবং সরকারকে চাপ সৃষ্টি করছে। এই প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করে তুলতে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলেই আমরা মনে করি।
বিএনপি সরাসরি সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। তাদের বক্তব্য, তফসিল ঘোষণার পর একজন প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রমাণ বলে উল্লেখ করে দলটি। হাদির হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে কি করে পালিয়ে যেতে পারে? প্রশাসনিক গাফিলতিতে আসামি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলেও অভিযোগ করে দলটি। হত্যার এক সপ্তাহ পার হলেও আসামিদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় সরকারের ব্যর্থতাকে উল্লেখ করে শনিবার আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাদীর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেয়া হয় ইনকিলাব মঞ্চ থেকে। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের কথা বলেছে জাতিসংঘ। এনসিপি নেতারা হাদি হত্যাকাণ্ডের আসামিদের পলায়ন ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। তারা হাদি হত্যার তীব্র নিন্দা ও আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, এই সহিংসতায় সরকারের একটি অংশ জড়িত রয়েছে। জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকেও এ হত্যার তীব্র নিন্দা ও দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানানো হয়। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, এটি “নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র”। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, “পরাজিত শক্তি ও ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীরা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়।”
ভারত-বিদ্বেষ কি কাল হলো হাদির?
শরিফ ওসমান হাদি পরিচিত ছিলেন ভারত-সমালোচক কণ্ঠ হিসেবে। তার বক্তব্যে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট। ফলে হত্যার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- এই অবস্থানই কি তার কাল হলো? তদন্তে ঘাতকদের ভারত পালানোর তথ্য, পলাতক নেতাদের ভারতে অবস্থান- সব মিলিয়ে বিষয়টি আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি হয়তো সরাসরি ‘ভারত-বিদ্বেষী আন্দোলন’ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাতের সঙ্গে আঞ্চলিক বাস্তবতার জটিল সংমিশ্রণ।
নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি: হাদি হত্যা কী বার্তা দিচ্ছে?
২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যার ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত বা দলীয় ক্ষতির বিষয় নয়- এটি পুরো নির্বাচনী পরিবেশ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ফলে একের পর এক গুরুতর প্রশ্ন সামনে আসছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ মনে করছে, এই হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই এমন হামলা দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির কৌশলের অংশ হতে পারে।
হাদির মতো পরিচিত ও আলোচিত একজন প্রার্থীকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হলে তার প্রভাব পড়বে পুরো রাজনীতির মাঠে। প্রার্থীরা আতঙ্কিত হবেন, দলগুলো নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হবে এবং সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এই দিক থেকে দেখলে, ঘটনাটি নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা কি না- সে প্রশ্ন এড়ানো কঠিন। হাদির মৃত্যুর পরপরই যে সহিংসতা দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থানে হামলা- তা ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন আশঙ্কা তৈরি করেছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিশোধমূলক বা উসকানিমূলক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার নজির বাংলাদেশে নতুন নয়। যদি হত্যার বিচার দ্রুত ও দৃশ্যমান না হয়, তাহলে হতাশা ও ক্ষোভ আরও জমতে পারে। সেই সুযোগে উগ্র বা ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী সহিংসতা বাড়াতে পারে- এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই। তাই এই পর্যায়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্ত সহিংসতা কমানোর বদলে যেন তা উসকে না দেয়, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
শীর্ষনিউজ