ময়মনসিংহের ভালুকায় গত বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে জামিরদিয়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড কারখানায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে দিপুকে মারধর করে কারখানার সহকর্মীরা। পরে তাকে কারখানার বাইরে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেয় সহকর্মীরা। এ সময় উত্তেজিত জনতা দিপু দাসকে পিটিয়ে হত্যার পর উলঙ্গ করে মরদেহ গাছে ঝুলিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে ভালুকা মডেল থানায় নেওয়া হয়। পরদিন ১৯ ডিসেম্বর ভোরে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকেলে নিহতের ছোট ভাই অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১৫০ জনকে আসামি করে ভালুকা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভালুকা উপজেলার বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে।
নিহতের সঙ্গে একই গার্মেন্টসে কর্মরত এক নারী সহকর্মী জানান, দিপু নিজের যোগ্যতায় গার্মেন্টসের কোয়ালিটি সুপারভাইজার পদে নিয়োগ পান। এরপর থেকে তার সঙ্গে শত্রুতা শুরু হয়। তিনি অত্যন্ত ভালো নম্র-ভদ্র ছেলে, অন্য ধর্মের হলেও আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত। দিপুর সঙ্গে সুপারভাইজার পদে আরও কয়েকজন তার সহকর্মী অর্থনৈতিক লেনদেনের চেষ্টা করেও ওই পদটি পায়নি।
তিনি আরও জানান, হয়তো এ ক্ষোভের জেরে তারা পরিকল্পিতভাবে তাকে জড়িয়ে গুজব ছড়ায়। তিনি ইসলাম ও মহানবীকে (সা.) অবমাননা করেছেন— এ কথাটি দ্রুত জনসমাগমের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এ সময় দিপু ফ্যাক্টরির ভেতরেই ছিল, অনেক কান্নাকাটি করে বলছিল— ‘আমি এসব কথা বলেনি’। তখন তার কথা কেউই বিশ্বাস করেনি। ফ্যাক্টরির ভেতরেই মেরে তাকে বাইরে বের করে দেয়। এ ঘটনাটি সম্পূর্ণ সাজানো ছিল এবং নিহত দিপু ধর্ম অবমাননার কোনো কথা বলেননি। আমাদের কোন সহকর্মীর কাছে এমন কথা বলছে— এ কথা কেউ বলতে পারেনি, সবাই বলেছে শুনেছি।
তিনি আরও বলেন, এমন কথা শোনা যাচ্ছিল যে সন্ধ্যার দিকে এক নারী সহকর্মী নামাজে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাকে কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করেন। ওই সহকর্মী নামাজে যাচ্ছেন বলার পর তিনি ‘নামাজ পড়ে কী হবে, আপনাদের নবীতো ...’ বলে মহানবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। এমন গুজব ছড়ানোর পর উত্তেজিত জনতা সত্যতা যাচাই না করেই হামলা চালায়। পরে তাকে মারধর করে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় এবং ঘটনার পর উল্লাস করা হয়।
তবে আরেকটি সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার কর্মস্থলে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে দিপু চন্দ্র দাস মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেন। কারখানার জুনিয়র কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর মো. সেলিম মিয়া ও জুনিয়র অপারেটর মোছা. রহিমা বেগম নামাজ সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বললে তিনি উক্ত মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার খবর দ্রুত অন্য শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে কারখানায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার (এডমিন ও কমপ্লায়েন্স) উদয় হোসেন কালবেলাকে বলেন, সেকশনের শ্রমিক ও আশপাশের লোকজন বিষয়টি জানতে পারলে কারখানার ভেতর ও বাইরে কয়েকশ মানুষ জড়ো হয় এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিপু চন্দ্র দাসের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কারখানার সিকিউরিটি ইনচার্জ সার্জেন্ট মশিউর রহমান (অব.) তাকে ১ নম্বর গেট সংলগ্ন সিকিউরিটি রুমে নিয়ে যান। উত্তেজিত জনতা কারখানার গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে তাকে বাইরে নিয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে সহিংসতায় তিনি মারা যান।
তিনি বলেন, আমরা এটার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার চাই। আমাদের দিক থেকে যত প্রকার সহযোগিতা দরকার আমরা সেটা করব। আমাদের কাছে যে যে সহযোগিতা চাইবে আমরা সর্বক্ষণ সেই সহযোগিতা করব। আমরা চাই এটার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু বিচার হোক। যে দোষী হবে সেই বিচারের আওতায় আসবে। এখানে আমাদের কোনো প্রকার কম্প্রোমাইজ নেই।
দিপুর ভাই ও মামলার বাদী অপু চন্দ্র দাস কালবেলাকে বলেন, আমার ভাই দুই বছর ধরে কোয়ালিটি সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছিল। আমার ভাইকে কী কারণে মারল জানি না। ওরা বলছে, আমার ভাই ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছে, কিন্তু তার কোনো প্রমাণ নেই। যদি এমনটি বলে থাকে, অপরাধ হয়েও থাকে, তাহলে আইনের মাধ্যমে বিচার হতে পারত। কিন্তু নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। যে সন্ত্রাসীরা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মেরেছে, তাদের বিচার চাই। এখন তার পরিবার কীভাবে চলবে জানি না।
নিহত দিপু চন্দ্র দাসের বোন চম্পা দাস বিলাপ করে বলেন, আমার ভাই বিএ পাস। সে সাধারণ বাটন মোবাইল ব্যবহার করত। ধর্ম নিয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। নবীকে নিয়ে কটূক্তি করার মতো মানুষ সে নয়। উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল এমন কথা শুনেছি। সেই কারণেই হয়ত তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেডের ফ্লোর ইনচার্জ আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের কোম্পানির বাইরে কোনো চায়ের দোকানে দিপু হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কটূক্তি করেছেন— এমন খবরে কারখানার ভেতরের শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। এ সময় শ্রমিকরা দাবি জানান, তাকে কারখানা থেকে বরখাস্ত করতে হবে। ওই সময় কারখানার গেটের বাইরেও একদল লোক এসে জড়ো হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কারখানা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমরা দিপুকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও কারখানার ভেতরে ও বাইরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। উত্তেজিত লোকজন দিপুকে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।
ভালুকা মডেল থানার ওসি মো. জাহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এ ঘটনায় ইতোমধ্যো ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে সবাইকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সেদিন আমরা রাত ৮টার পর খবর পাই। ঘটনা শুরু হওয়ার সময় খবর পেলে এমন মৃত্যু হতো না, ছেলেটিকে বাঁচানো যেত। আমরা জড়িত সবাইকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছি।
ময়মনসিংহ র্যাব-১৪ অধিনায়ক নয়মুল হাসান বলেন, ঘটনার সূত্রপাত হয় বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে। কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ তাকে (দিপু) চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে উত্তেজিত জনতার কাছে হস্তান্তর করেন। পুলিশের কাছে কেন হস্তান্তর করেনি এবং তার নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা হয়নি, সে কারণে কারখানার সংশ্লিষ্ট দুই কর্মীকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি।
তিনি আরও বলেন, ধর্ম অবমাননার বিষয়টি খুবই অস্পষ্ট। তিনি কী বলেছেন, এটি খোঁজার চেষ্টা করলেও কেউ এটি বলতে পারেনি। কারও সঙ্গে পূর্বশত্রুতা ছিল কি না, সেটি আমরা তদন্ত করে দেখছি। ঘটনার সূত্রপাত কার সঙ্গে হয়েছে, সেটি শনাক্ত করা যায়নি। তবে আমরা জানতে পেরেছি, কাজ করার সময় ফ্লোরেই বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয় এবং তাকে কোনোভাবেই আর কারখানার ভেতরে রাখা যাচ্ছিল না। পরে তাকে ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা আসামিদের ধরেছি। কী কারণে ঘটনা ঘটেছে, তা উদ্ঘাটন ও জড়িত সবাইকে ধরতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।
দিপু দাস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও শাস্তির দাবিতে ময়মনসিংহে বিভিন্ন সংগঠনের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ : ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে ভালুকায় পাইয়নিয়ার নিটওয়ার লিমিটেড কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যার পর উলঙ্গ করে মরদেহ গাছে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়ে দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সচেতন সনাতনী সমাজ, গার্মেন্টস শ্রমিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।
হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে রোববার (২১ ডিসেম্বর) বিকেলে ময়মনসিংহ নগরীর ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে সচেতন সনাতনী সমাজ। মানববন্ধনে জাতীয় হিন্দু মহাজোটসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। এতে বক্তব্য রাখেন ডা. ভবতোষ কর্মকার, বিজয় চৌধুরী, টোটন ভট্টাচার্য, শংকর সরকার, সঞ্জয় দত্ত, প্রান্ত সরকার, সুবল পন্ডিত, লিমন দেবনাথসহ হিন্দু মহাজোটের নেতারা। মানববন্ধনে বক্তারা কারখানার মালিকসহ প্রকৃত দোষীদের শান্তি দাবি করেন।