Image description
 

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। এ নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতও বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। প্রায় সব দেশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। এর বাইরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় সবাই ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের কথা বললেও ভারত বলছে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের কথা।

 

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে এ দুটি নির্বাচন একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে।

 

নির্বাচন সামনে রেখে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ এবং স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক দল আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির নানা দিক সামনে আনছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু উপায়ে সম্পন্ন করার ওপর নজরদারির জন্য অনেক পর্যবেক্ষক পাঠানোর কথা বলছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিদের সরকারের প্রস্তুতির দিকগুলো জানান পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম। পররাষ্ট্র সচিব কূটনীতিকদের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদাসতর্ক ও সচেষ্ট রয়েছে।’

 

এর বাইরে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাস ও মিশনগুলোর নিরাপত্তার ব্যাপারেও কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করা হয়। রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এ ‘কূটনৈতিক ব্রিফিং’ অনুষ্ঠিত হয়।

সরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আকস্মিকভাবে এ ‘কূটনৈতিক ব্রিফিং’ ডাকার নেপথ্যে রয়েছে ভারত সরকারের কিছু পদক্ষেপ। দেশটি গত বুধবার দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে ডেকে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কিছু ‘অভিযোগ’ করেছে। একই সঙ্গে এখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে।

 

২০০৯ সাল থেকে ১৫ বছরে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের সময় দিল্লি থেকে এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান আসেনি, এমন কারণ দেখিয়ে এবারকার নির্বাচন প্রসঙ্গে ভারতের বক্তব্যকে অন্তর্বর্তী সরকার ভালোভাবে নেয়নি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রতি ইঙ্গিত করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বুধবার বলেন, সেই সময় নির্বাচনগুলো যে প্রহসনমূলক হয়েছিল, সে বিষয়ে ভারত একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি।

উপদেষ্টা মনে করেন, গত ১৫ বছর মূলত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ‘মধুর সম্পর্ক’ থাকায় ভারত ভোটের প্রশ্নে নীরব থাকে। এ কারণে এবারকার নির্বাচন নিয়ে ভারতের দেওয়া বক্তব্য ‘গ্রহণযোগ্য নয়,’ এটা তিনি স্পষ্ট বলে দেন।

ভারতীয় কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, দেশটি যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এবারই প্রথম আগ্রহ দেখাচ্ছে, এমন নয়। ভারতীয় কুশীলবরা সাধারণভাবে নেপথ্যে সক্রিয় থাকলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়ও দেশটি কোনো রাখঢাক না রেখেই প্রকাশ্যে নামে। তবে ২০২৬ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতীয়দের সক্রিয় হওয়ার কারণ ভিন্ন।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর তার দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। আদালতের রায়ে দন্ডিত হওয়ায় সশরীরে হাজির হয়ে উচ্চ আদালতে আপিল ছাড়া তার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ এখনো খুব সীমিত। শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে গত রবিবার তলবসহ কয়েকবার কূটনৈতিক চ্যানেলে দেশটির সরকারকে অনুরোধ করে। তবে এর আগে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, শেখ হাসিনার ভারতেই থাকবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় ভিসা ইস্যু সীমিত করা, স্থল-বাণিজ্যে নানা বিধিনিষেধ আরোপ ও শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ না করাসহ অনেক কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। এমন পরিস্থিতিতেও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়টি ভারতীয়রা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যেও আলোচনায় আনছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরসহ স্থানীয় কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয়রা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বলতে যেমন নির্বাচন বোঝায়, তার সঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলো থেকে তোলা ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের আলোচনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে।

বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি দিল্লিতে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় ২০২৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের ‘প্রয়োজনীয়তার’ কথা তুলে ধরেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, গণআন্দোলনের মুখে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরকার পতনের পর তিন দেশেই নির্বাচন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালে ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হচ্ছে। এমনটা হলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক হবে কি না, সে বিষয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগে দিল্লি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সক্রিয় হলেও সেটা ঘটেছিল ভিন্ন কারণে শেখ হাসিনার সরকারের মিত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি ভোট বয়কটের হুমকি দেওয়ার পর। ওই নির্বাচনের ঠিক মাসখানেক আগে দিল্লি থেকে উড়ে আসেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল নির্বাচন বয়কট করলেও সুজাতার দূতিয়ালিতে জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির বলেন, উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো নিজেদের দেশ ও সমাজে চর্চা করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবস্থান থেকে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার কথা বলে থাকে।

ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি, জার্মানির রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইসসহ পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বোঝাতে ভোটে ‘জনগণের অংশগ্রহণের’ কথা বলছেন।

জার্মানির রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোৎজ গত ২৬ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেন, অবাধ, সুষ্ঠুও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অর্থ হলো জনগণের ভোট দেওয়ার পূর্ণ সুযোগ নিশ্চিত করা এবং কাউকে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত না করা।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি মাইকেল মিলার গত ৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেন, এ দেশের সব অংশীজনকে বহু বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

জাতিসংঘের বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস গত জুনে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, জনগণের অংশগ্রহণ সঠিকভাবে হলে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে।