Image description

‘জান দেব, জুলাই দেব না’ এমন স্লোগানে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন শরীফ ওসমান হাদি। জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখতে অভ্যুত্থানের পর তৈরি করেন ইনকিলাব মঞ্চ নামের একটি প্লাটফর্ম। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থেকে নিয়ে সংস্কার, বিচার ও ভারতীয় আগ্রাসন; জুলাইয়ে তৈরি কোনো আকাঙ্ক্ষাতেই ছাড় দেননি তিনি। বিনিময়ে জীবনটাই শেষে দিতে হল এই বিপ্লবী তরুণকে। 

সবাই যখন মৃত্যুকে ভয় পায়, তখন হাসতে হাসতেই আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন হাদি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দীর্ঘ ৬ দিন জীবন-মৃত্যুর লড়াই শেষে অবশেষে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। 

ওসমান হাদির জন্ম ঝালকাঠির নলছিটিতে। তার বাবা মাদরাসার শিক্ষক। তিনিও ঝালকাঠির নেছারাবাদ কামিল মাদরাসা থেকেই পড়াশোনা শুরু করেন। পরে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। 

শিক্ষা জীবন থেকেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন এই যুবক। অভ্যুত্থানের আগে ওসমান হাদি লেখালেখিতে যুক্ত ছিলেন। তিনি একটি কবিতার বই লিখেছেন ‘লাভায় লালশাক পূবের আকাশ শিরোনামে। লিখতেন সীমান্ত শরীফ নামে। 

অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তার হাত ধরে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য। 

অভ্যুত্থানের যুক্ত হয়েছিলেন অভ্যুত্থানের পর তরুণদের নিয়ে গড়া জাতীয় নাগরিক কমিটিতেও। তবে নিজের দায়িত্বকে কেবল রাজনৈতিক থেকে বড় মনে করে রয়ে যান ইনকিলাব মঞ্চে। জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে তরুণদের রাজনৈতিক দলে আর যাননি। 

জুলাই অভ্যুত্থানের পর তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, অভ্যুত্থানে হত্যা ও হামলায় জড়িতদের বিচার, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কর্মসূচি ও বক্তব্য দিয়ে তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। 

তিনি একইসঙ্গে ভারতীয় আগ্রাসন নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। আধিপত্যবাদবিরোধী একাধিক কর্মসূচিও পালন করেছেন। 

একদিনে রাজনৈতিক সক্রিয়তা অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানকে বাঁচিয়ে রাখতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড-দুটোই সমানতালে করে গেছেন হাদি। 

জুলাই নিহতদের স্বীকৃতি এবং আহতদের যথাযথ চিকিৎসা দিতেও তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। এসব কর্মকাণ্ড হাদিকে আলোচিত করেছিল। জুলাই ঘোষণাপত্র এবং পরে জুলাই সনদ নিয়েও তিনি বক্তব্য দেন নিয়মিত, যা তাকে আলোচনায় নিয়ে আসে।  

এছাড়াও তিনি ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেন। ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড এবং ২০১৩ সালের শাপলার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সরব ছিলেন তিনি। ২০২১ সালের মোদিবিরোধী আন্দোলনে হত্যা এবং সীমান্ত হত্যা নিয়েও তিনি সর্বদা বক্তব্য দিয়েছেন। 
টিভি টকশো থেকে শুরু করে রাজপথ-সর্বত্র তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের আলোচনাকে প্রাসঙ্গিক রেখেছেন। ফলে একদল শত্রুও তৈরি হয় তার। 

গত সেপ্টেম্বর থেকেই তাকে হত্যা হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা সময়ে এসব বিষয়ে জানিয়েছেন তিনি। 

গত নভেম্বরে এক পোস্টে তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি ফোন নম্বর থেকে তাকে ফোন এবং মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে, তার বাড়িতে আগুন দেওয়া ও তার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তার নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি বলেও গত কয়েকদিন ধরে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে। 

জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া তরুণদের তিনি সর্বাগ্রে রাখতেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতারা যখন গোপালগঞ্জ গিয়ে আক্রান্ত হন, তখন  গোপালগঞ্জের নাম বিলুপ্ত করে দেওয়ার ডাক দেন তিনি। তার শব্দচয়নও তখন বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। 

হাদি তার লড়াই ছেড়ে দেননি। তিনি সর্বশেষ ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছিলেন। এরমধ্যেই গত ১২ ডিসেম্বর তাকে গুলি করা হয়। গুলির পর থেকেই নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত আর চোখ খোলেননি।