Image description

থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী এক মৃত্যু আমাদের কাঁধে এসে পড়েছে বৃহস্পতিবার রাতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক যুগ-সন্ধিক্ষণে, ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর মোড়ে দাঁড়িয়ে যে সাহস বুক পেতে দিয়েছিল সে বুক আজ নিথর। গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের লড়াইয়ের ময়দানে যে কণ্ঠ ছিল অবিচল, যে চোখে ছিল ভবিষ্যতের স্বপ্ন, সেই কণ্ঠ আজ নীরব, সেই চোখ চিরতরে বন্ধ।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদি আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার চলে যাওয়া কোনো সাধারণ মৃত্যু নয় এ এক রাজনৈতিক ক্ষয়, এক নৈতিক শূন্যতা, এক প্রজন্মের স্বপ্নে নেমে আসা গভীর অন্ধকার। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থেকেও তিনি ছিলেন বাংলার রাজপথে, মানুষের অধিকারের পাশে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক অদম্য নাম।

তিনি জানতেন এই পথ ঝুঁকির, এই লড়াইয়ের মূল্য আছে। তবু তিনি পিছু হটেননি। বুক পেতে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র ভিক্ষা নয়, অধিকার; ন্যায়ের পথে নীরবতা অপরাধ। তার জীবন ছিল এক জীবন্ত প্রতিবাদ, আর তার মৃত্যু হয়ে উঠল এক ভারী প্রশ্ন আমরা কী সেই সাহস ধারণ করতে পারবো?

বৃহস্পতিবার (১৮ই ডিসেম্বর) রাতে ইনকিলাব মঞ্চ তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সত্যটা আরও গভীর; আজ শুধু একজন মানুষ নয়, আজ পতন হলো একটি দীপ্তকণ্ঠ, একটি নির্ভীক উপস্থিতি। তবু ইতিহাস সাক্ষী এমন মানুষরা কখনো পুরোপুরি মরে না। তারা রয়ে যায় লড়াইয়ের ভাষায়, প্রতিরোধের শপথে, নতুন প্রজন্মের চোখে। শরীফ ওসমান হাদি আপনি থাকবেন। আপনার সাহস থাকবে। আপনার স্বপ্ন থাকবে। আর এই শূন্যতা তরুণ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে গণতন্ত্রের পথ কখনো সহজ নয়, কিন্তু সেই পথে হাঁটার মানুষরা অমর।

ইতিহাস স্বীকার করবে, তার অবদান কেবল কোনো সংগঠনের নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছিল একটি সময়ের নৈতিক প্রতিবাদ, একটি প্রজন্মের সাহসী উচ্চারণ। শরীফ ওসমান হাদির জীবন ছিল সংগ্রাম, সাহস ও দায়বদ্ধতার এক অনন্য দলিল। তিনি রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন দায়িত্ব হিসেবে, আত্মত্যাগের ক্ষেত্র হিসেবে। যখন ভয় ছিল রাষ্ট্রের নিত্যসঙ্গী, যখন নীরবতা হয়ে উঠেছিল টিকে থাকার কৌশল ঠিক তখনই তিনি কথা বলেছেন। স্পষ্ট, দ্বিধাহীন, আপসহীন।

হাদি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র কোনো বিমূর্ত ধারণা নয় এটি মানুষের দৈনন্দিন মর্যাদা, ভোটের অধিকার, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি রাজপথে নেমেছেন, আন্দোলন গড়েছেন, তরুণদের সংগঠিত করেছেন। দমনপীড়ন, নজরদারি, হুমকি কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। কারণ তার সংগ্রাম ব্যক্তিগত নয়; তা ছিল সামষ্টিক মুক্তির স্বপ্নে প্রোথিত।

তিনি জানতেন, ফ্যাসিবাদ কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয় এটি ভয় তৈরি করে, মানুষকে একা করে দেয়। তাই তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাহসের সংস্কৃতি তৈরি করা। যারা প্রথমবার রাজপথে নামতে ভয় পেতো, তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যারা কথা বলতে দ্বিধায় ছিল, তিনি তাদের কণ্ঠে আস্থা জুগিয়েছেন।

শরীফ ওসমান হাদির সাহস প্রদর্শনমূলক নয়- ছিল নীরব, গভীর, দৃঢ়। তিনি জানতেন এই সাহসের মূল্য দিতে হতে পারে জীবন দিয়েও। তবু তিনি পিছু হটেননি। বুক পেতে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ইতিহাস কখনো নিরাপদ মানুষের কাঁধে ভর করে এগোয় না; এগোয় ঝুঁঁকি নেয়া মানুষের রক্তে-ঘামে।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও তার আহত শরীর-মন পড়ে ছিল দেশের দিকে, আন্দোলনের দিকে, মানুষের ভবিষ্যতের দিকে। শারীরিক দুর্বলতা তার রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে ভাঙতে পারেনি। এই অদম্য মানসিক শক্তিই তাকে আলাদা করেছে একজন সাধারণ কর্মী থেকে এক প্রতীকী চরিত্রে।

তার মৃত্যু একটি শূন্যতা কিন্তু সেই শূন্যতাই পূরণের দায় জাগ্রত জনতার। তারুণ্যের দায় তার আদর্শ বহন করার, তার সাহসকে ছড়িয়ে দেয়ার, তার অসমাপ্ত স্বপ্নকে সম্পূর্ণ করার। তিনি জুলাইয়ের পটভূমিতে শিখিয়ে গেছেন গণতন্ত্র রক্ষা করা মানে শুধু ভোট দেয়া নয়; প্রয়োজনে বুক পেতে দেয়া।
শরীফ ওসমান হাদি চলে গেছেন, কিন্তু তার অবদান রয়ে গেছে সংগ্রামের ভাষায়, সাহসের ইতিহাসে এবং জাতির আত্মজিজ্ঞাসার প্রশ্নে; আমরা কী তার মতো নির্ভীক হতে পারবো?