Image description

মাহমুদুর রহমান

 

ওসমান হাদির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ভার্চুয়াল জগতে। আমি তখন তুরস্কে নির্বাসিত। মালয়েশিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় বেলাল এবং আরিফ নামের দুই প্রতিভাবান, দেশপ্রেমিক তরুণের সঙ্গে খুব সখ্য হয়েছিল।

ওরা এখন লন্ডনে। আইআইইউএম থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে লন্ডনের বিখ্যাত সোয়াসে (School of Oriental and African Studies) মাস্টার্স করে এখন সেখানেই পিএইচডি করছে। ওরা একদিন ঢাকার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কয়েকজন তরুণের সঙ্গে জুম মিটিংয়ের প্রস্তাব করলে আমি সম্মত হই। ল্যাপটপের স্ক্রিনে সেই প্রথম অগোছালো চুলের হাদিকে দেখলাম। চমৎকার গুছিয়ে সেদিন কথা বলেছিল। আমি চরম অন্ধকার সময়েও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হয়েছিলাম।

মনে হয়েছিল, ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবিলায় এমন টগবগে তরুণের দলই তো দরকার। ইনকিলাব মঞ্চ নিয়ে ওর স্বপ্নের কথাও বলেছিল। এরপর যেদিন নির্বাসন থেকে ঢাকায় ফিরলাম, হাদি দলবল নিয়ে হাজির হয়েছিল বিমানবন্দরে। নাছোড়বান্দা তরুণরা বাধ্য করেছিল দীর্ঘ বিমানযাত্রার ক্লান্তির মধ্যে ওদের ট্রাকে উঠে বক্তৃতা দিতে।

এরপর একে একে আমার পুত্রকন্যাসম ইনকিলাব মঞ্চের জাবের, বোরহান, জুমার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। ডাকসুর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক জুমা আর জাবের তো কিছুদিন আমার দেশ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে আলফাজ আনামের সঙ্গে কাজও করেছিল। গত জুলাই মাসের ছয় তারিখ প্রত্যুষে আমার মায়ের লাশ গুলশানের আজাদ মসজিদ থেকে গোসল করিয়ে বাসায় এনে দেখি হাদি চলে এসেছে। জুরাইন কবরস্থানে দাফন পর্যন্ত সর্বদা মুখর হাদি সেদিন নীরবে আমার পাশে থেকেছে। আমি আর হাদি মিলেই আমার মায়ের লাশ চিরদিনের জন্য কবরে শুইয়ে দিয়েছিলাম।

হাদি আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে হাদিকে কাছ থেকে শ্রদ্ধাপূর্ণ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছি। এই যুগে এমন নির্লোভ ছেলে হয় আমার জানা ছিল না। আমার কোনো ক্ষমতা না থাকলেও কত মানুষ নানা প্রয়োজনে আমার কাছে আসে। অথচ এত ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও হাদি কখনো তার কোনো চাহিদার কথা আমার কাছে ব্যক্ত করেনি।

সংসারের অভাব-অনটনের প্রসঙ্গই কোনোদিন তোলেনি। গত এক বছরে কত তরুণকেই তো বেদনার সঙ্গে পথভ্রষ্ট হতে দেখলাম। কিন্তু অদ্বিতীয় হাদি নৈতিক আদর্শে অটল থেকেছে। ছেলে হওয়ার পর ও কী যে খুশি হয়েছিল! আমি ওকে বলতাম, এবার অন্তত সন্তান এবং স্ত্রীকে কিছুদিন সময় দাও। কীসের কী! সংসারের দিকে তাকানোর সময় কোথায় ওর? সারাক্ষণ অস্থির হাদি ঘামে ভেজা শরীর আর মাথায় অবিন্যস্ত চুলের বোঝা নিয়ে দেশরক্ষার পাগলামি বুকে নিয়ে অবিরত ছুটে বেড়িয়েছে। আমি সারা জীবন ক্যারিয়ারসর্বস্ব হলেও বিপ্লবী হওয়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছা সর্বদা লালন করেছি।

হাদির মধ্যে আমার সেই হতে না পারা বিপ্লবীকে যেন দেখতে পেতাম। হঠাৎ একদিন আমার দেশ অফিসে এসে বলল, দেশ পরিবর্তন করতে হলে সংসদে যেতে হবে। কপর্দকশূন্য হাদি নির্বাচনের ময়দানে নেমে পড়ল একটি প্রধান দলের বেশুমার বিত্তের অধিকারী একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে। আমি ভাবলাম, করুক না পাগলামি। অসম্পূর্ণ জুলাই বিপ্লব সম্পূর্ণ করার জন্য সংসদে তো আমাদের হাদিদেরই প্রয়োজন। হয়তো ওরা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর অর্থ এবং পেশির কারণে ভোটযুদ্ধে পরাভূত হবে। কিন্তু জাতিকে ওদের প্রজন্ম যে বার্তাটি দিয়ে যেতে পারবে সেটি রাষ্ট্রের পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে। আমি মনে করি, হাদি সফল হয়েছিল। মাত্র অল্প কয়েকদিনের নতুন ধারার ক্যাম্পেইনে রাজনৈতিক ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ রীতিমতো কেঁপে উঠেছিল। ও জীবনে ‘ইমপ্যাক্ট’ তৈরি করতে চেয়েছিল। আল্লাহ হাদির মনের আশা পূর্ণ করেছেন। হাদি আজ আইকন হয়েছে। কিন্তু আমরা তো এমন ‘ইমপ্যাক্ট’ চাইনি।

আমি হাদিকে নিয়ে যখন লিখছি তখন ও জীবনমৃত্যুর মাঝখানে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। এই কদিন ধরে কেবল ভেবে চলেছি ওকেই কেন টার্গেট করল। হাদি তো সরকারের অংশ হয়নি, কোনো দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায় নামেনি। ভাবতে ভাবতে হয়তো উত্তরও খুঁজে পেয়েছি। হাদি টার্গেট হয়েছে কারণ সে অনমনীয় দৃঢ়তায় ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। কারণ হাদি বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের গর্বিত বিশ্বাসে উন্নত শিরে দাঁড়িয়েছিল। কারণ হাদি আল্লাহর কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করেছিল। কারণ হাদি জুলাই বিপ্লবের সহযোদ্ধাদের প্রতি মমতাময় ছিল। কারণ হাদি জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে ক্রমেই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের আইকনে পরিণত হচ্ছিল। কারণ হাদি নির্লোভ ছিল। কারণ হাদি অকুতোভয় ছিল।

সর্বোপরি হাদিকে কেনা যাচ্ছিল না। হাদির এই অসাধারণ চরিত্রবান ও লড়াকু বিশেষত্ব আওয়ামী ফ্যাসিস্ট, ভারতের দালাল এবং ইসলামোফোবিক অপশক্তির কাছে তাকে এক ভীতিকর চরিত্রে পরিণত করেছে। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরদিন বিএনপির একজন নব্য সমর্থক, কট্টর বামপন্থি ইউটিউবারের এ বিষয়ে বক্তব্য শুনছিলাম। হাদির ওপর আততায়ীর হামলার নিন্দা করতে গিয়ে তিনি বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, তার বিবেচনায় হাদি একজন অতি উগ্র মৌলবাদী পপুলিস্ট, যার রাজনীতিকে সেই ইউটিউবার খুবই অপছন্দ করেন। একই দলের অপর একজন ইউটিউবার হাদিকে দানব বলেছিলেন।

সুশীলত্ব এবং সেক্যুলারিত্বের মুখোশধারী এই ইসলামোফোবিক শ্রেণিকে আমি ভালো করেই চিনি। আমারও হাদির মতো অভিজ্ঞতা রয়েছে। শেখ হাসিনার পুলিশ যখন আমার দেশ তালাবন্ধ করে দিয়ে আমাকে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছিল, সেই সময় উপরোক্ত ইউটিউবারদের সমচরিত্রের একজন সিনিয়র ‘আল্ট্রা সেক্যুলার’ সম্পাদক একই রকম ভাষায় বলেছিলেন যে, আমি অত্যন্ত বাজে প্রকৃতির মানুষ হলেও সরকারের আমার ওপর অত্যাচার করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। সেই সম্পাদক বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, শুধু তার মহত্ত্বের কারণে তিনি মাহমুদুর রহমানের মতো একজন নিম্ন শ্রেণির ব্যক্তির পক্ষে কথা বলছেন। সেক্যুলারিত্বের মুখোশধারী এই শ্রেণি প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এরাই এখন দল বেঁধে বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। হাদি এদেরকেই ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ নামে ডাকে। ইতোমধ্যে ভারতের ক্ষমতাসীন কট্টর হিন্দুদের দল বিজেপি সমর্থক মিডিয়ায় দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার আততায়ী দল হাদির ওপর গুলি চালিয়েছে। সেই সব মিডিয়া আততায়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছে। ওরা হাদিকে ভারতের স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক ঘোষণা করেছে। হাদিকে নিয়ে চরম মুসলিমবিদ্বেষী বিজেপির মিডিয়া এবং বিএনপি সমর্থক থিংকট্যাংকের একই ধরনের মূল্যায়ন নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র খানিকটা প্রকাশ করেছে।

নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে যা কাকতালীয় ভেবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হাদির ওপর আততায়ীর হামলা নিয়ে লেখার পর এবার দ্বিতীয় ঘটনায় যাচ্ছি। তফসিল ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। গণমাধ্যমের প্রায় দুই দশকের অভিজ্ঞতায় ধারণা করছি, বিশেষ উদ্দেশ্যে একেবারে তফসিলের দিন ‘রিলিজ’ করার জন্য সাক্ষাৎকারটি আগেই নেওয়া ছিল। রাষ্ট্রপতি চুপ্পু সেই সাক্ষাৎকারে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে তার যাবতীয় গোসসার কথা বলেছেন।

তাকে নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অপমান করেছে। ফ্যাসিস্ট জামানায় সাহাবুদ্দিন চুপ্পু রাষ্ট্রপতি হয়েছেন জানার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন যে, একবার রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলে শেখ হাসিনার আর পদধূলি নিতে পারবেন না এটাই তার সবচেয়ে বড় দুঃখ। দানব হাসিনার পদধূলি নেওয়ার আগে চুপ্পু বাংলাদেশের এক নম্বর লুটেরা ব্যবসায়ী এস আলমকেও কদমবুসি করেছেন। এস আলম ইসলামী ব্যাংক দখল করলে তার পক্ষে চুপ্পু ব্যাংকের পরিচালক হয়েছিলেন। অর্থাৎ এস আলম ইসলামী ব্যাংক থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করেছেন, তার জন্য সাবেক পরিচালক সাহাবুদ্দিন চুপ্পুও সমভাবে দায়ী। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার আগে চুপ্পু দুদকের কমিশনার ছিলেন।

সে সময় তিনি তৎকালীন আইনমন্ত্রী, বর্তমানে জুলাই গণহত্যার দায়ে বিচারাধীন আনিসুল হক এবং দুদকের সাবেক আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের সঙ্গে মিলে এক ট্রয়কা গড়ে তুলেছিলেন। সেই ট্রয়কা বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের ভুয়া মামলায় জেলে ঢোকানোর পাশাপাশি দুদককে অঢেল সম্পদ বানানোর মেশিনে পরিণত করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি না হলে এতদিনে তার বিরুদ্ধে দুদকের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চালানোর কথা ছিল। জুলাই গণহত্যায় তার ভূমিকাও হয়তো আলোচনায় চলে আসত। এহেন ‘মহামান্য’ ব্যক্তির অপমান হয়েছে ভাবতেও অবাক হচ্ছি। আমি মনে করি, তিনি যে এখনো বঙ্গভবনে আছেন সেটাই জুলাই বিপ্লবের অপমান এবং ব্যর্থতা।

৫ আগস্টের পর কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সাংবিধানিক শূন্যতার অজুহাতে বিষবৃক্ষ কর্তনের বিপক্ষে যে অবস্থান নিয়েছিল, তার চূড়ান্ত পরিণতি আমাদের এখনো দেখার বাকি আছে। রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি চুপ্পু আরো একটি বিপজ্জনক ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, বর্তমান সরকারের মধ্যে একমাত্র সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। যে কেউ এই বক্তব্যকে সরকারপ্রধানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর অনভিপ্রেত দূরত্ব তৈরির অপপ্রয়াস হিসেবে দেখতে পারেন। বাংলাদেশ যখন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, সেই সময় গণপরিসরে রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর কথাবার্তা জনমনে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করব যে, বঙ্গভবন এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে।

আমি আগে থেকেই বলে আসছি যে, শেখ হাসিনা এবং দিল্লিতে তার প্রভুরা বাংলাদেশে একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সব রকমে বাধা সৃষ্টি করবে। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে দেশে আওয়ামী ধারায় বিভক্তির বয়ান তৈরি, ওসমান হাদির ওপর প্রাণঘাতী হামলা এবং তফসিল ঘোষণার দিন রয়টার্সে রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর আকস্মিক সাক্ষাৎকার প্রকাশকে আমি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ভারতীয় কৌশলের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করি। জাতিকে সম্ভবত আরো একটি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে হবে। হাদিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহতায়ালার কাছে নতমস্তকে আকুতি জানিয়ে আজকের লেখা সমাপ্ত করছি।