Image description

প্রশাসনের কেউ কোনোদিন আমাকে জরিমানা করেনি, সতর্কও করেনি। রাজধানী ঢাকায় আজ থেকে দশ বছর ধরে প্রকাশ্যে ধূমপান করে আসছি, এমনকি পুলিশের সামনে ধূমপান করলে তারাও কখনও বাধা দেন না। বরং পুলিশই আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে। এসব কথাগুলো বলছিলেন, ঢাকার মিরপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন। ৬ ডিসেম্বর সকালে ঢামেকের করিডোরে প্রকাশ্যে ধূমপান করার সময় এ প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে তাকে আইনি বিষয়ে দৃষ্টিআকর্ষণ করলে ওই স্বজন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।

২০০৫ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাশ করে। এই আইনে পাবলিক প্লেস (যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, সিনেমা হল, হাসপাতাল, মেলা, যাত্রী ছাউনি, পাবলিক টয়লেট, আদালত ভবন ইত্যাদি) এ ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়। কেউ আইন অমান্য করলে ৫০ টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনটিতে কিছু সংশোধন আনা হয়। বর্তমানে এই আইন অনুযায়ী পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে ৩০০ টাকা অর্থদণ্ড হবে। আর কেউ এরপরে আবারও একই অপরাধ করলে অর্থদণ্ড দ্বিগুণ হবে। কিন্তু প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ন্ত্রণে এই আইন কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে, এ নিয়ে প্রশ্ন সর্বত্র। ঢামেকের করিডোরে প্রকাশ্যে ধূমপান করা ওই রোগীর স্বজন জানান, তিনি জানেনই না যে, প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ এবং জরিমানার বিধানও রয়েছে। অর্থ্যাৎ এই আইনটি বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা চালানো হয়নি। আইনের যথাযথ প্রয়োগও করা হয়নি। ওই স্বজনের বায়ান বলছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরাও প্রকাশ্যে ধূমপান করছেন।

জনসচেতনতার ঘাটতি এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে রাজধানীসহ দেশের প্রায় সর্বত্র প্রকাশ্যে ধূমপান স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড, বাজার এলাকা, রেলস্টেশন, চায়ের দোকান কিংবা রেস্তোরাঁ যে কোনো জায়গায় সহজেই দেখা যায় ধূমপায়ীদের প্রকাশ্যে ধূমপানের দৃশ্য। আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি সত্ত্বেও খুব কম লোকই প্রতিবাদ করেন, আবার সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। ফলে দেশে প্রকাশ্যে ধূমপান আইনত  দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এ আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রায় ৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক সেবন করছে। তারা পরোক্ষভাবে ক্ষতি করছে প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ মানুষের। ধূমপান না করেও কেউ যেন পরোক্ষভাবে এর কুফলের শিকার না হন, এ লক্ষ্যে প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়। এ কারণে আইনও করা হয়, কিন্তু কোনো সরকারই এই আইনের কঠোর প্রয়োগে কঠোর হয়নি। ফলে ধূমপান না করেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ-কোটি নাগরিক।

তথ্য বলছে, প্রতিবছর তামাকজাত পণ্য ব্যবহার ও সেবনে লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। আর এ ধরনের  মৃত্যুর পেছনে সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো ধূমপান। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যঝুঁকিই শেষ নয়, এতে অপচয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণে অর্থ। ধূমপানের ধোঁয়ায় থাকে হাজারো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যার মধ্যে ৭০টি সরাসরি ক্যানসার সৃষ্টি করে। ধূমপানের ফলে মুখ, অগ্ন্যাশয়, ফুসফুস, গলা, কিডনি এমনকি জরায়ুরও ক্যানসার হতে পারে। পাশাপাশি, ধূমপানের অন্যতম বড় ক্ষতি হচ্ছে হৃদরোগের ঝুঁকি। ধূমপানের ধোঁয়া বাতাসে মিশে গিয়ে শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে।

বিশ্ব  স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ২০ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশের হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী ধূমপান তথা তামাক ব্যবহার। তামাক ব্যবহারজনিত রোগ ও মৃত্যু এখন আতঙ্ক। আমাদের দেশের জন্যে একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জও বটে।

আলী আজগর নামে এক যুবক চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওই যুবক চিকিৎসক এর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময় তার পাশে ধূমপান করছেন অপর এক ব্যক্তি। এসময় কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। আলী আজগর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি একজন অ্যাজমা রোগি, নিজে ধূমপান করি না কিন্তু আমার পাশে কেউ ধূমপান করলে আমার নানাবিদ সমস্যা হয়। আমাকে প্রতিনিয়ত এমন সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। তিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে ধূমপানরত দুই পুলিশ সদস্যকে দেখিয়ে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই যদি এমন কাজ করেন তাহলে কার কাছে বিচার দেবো।

ওই যুবক আরও বলেন, মাঝেমধ্যে ধূমপায়ীকে আমার সমস্যার কথা বললে তারাই আবার উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ধূমপায়ীদেরও উচিত পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যে ধূমপান না করা।

রাজধানীর পুরান পল্টনমোড় মেট্রো রেলস্টেশন দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধার সঙ্গে প্রকাশে ধূমপান নিয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ধূমপায়ীদের কারণে রাস্তায় আর চলা যায় না। ধূমপায়ীরা পথচারীদের মুখের সামনে সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে চলে যায়, এর প্রতিবাদও করা যায় না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দেশে প্রচলিত আইন থাকলেও তা কার্যকর নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং তাৎক্ষণিক প্রভাব সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায় না। অনেক সময় শুধুমাত্র প্রচারণার অংশ হিসেবে অল্প কিছু জরিমানা করা হয়, এরপর পরিস্থিতি আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়।

তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর দাবি, দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমলেও প্রকাশ্যে ধূমপানের ঘটনাগুলো এখনও ব্যাপক হারে বাড়ছে। আইন কার্যকর না হওয়ায় ধূমপায়ীরা মনে করেন এটি অপরাধ নয়। আবার অনেকে ধূমপানকে স্বাভাবিক অভ্যাস হিসেবেই দেখেন। অন্যদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্য নিজেরাই ধূমপায়ী হওয়ায় কার্যক্রমে আগ্রহ কম বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র সবখানে ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে। তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও স্পনসরশিপে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র আইন প্রয়োগের বিষয় নয় এটি একটি সামাজিক আন্দোলনও। ব্যক্তিগত অভ্যাস পরিবর্তন, সামাজিক চাপ সৃষ্টি, পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং আইনগত পদক্ষেপ সব মিলিয়েই ধূমপান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধ করতে হলে জরিমানা বৃদ্ধি, নিয়মিত নজরদারি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য।

২০০৫ সালে আইন প্রণয়নের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধে কতটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল টোব্যাকো কন্ট্রোল সেলের কর্মকর্তা মাসুদ আহমেদ শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নাই। গত সপ্তাহে কোনো অভিযান হয়নি। তবে নভেম্বর মাসে দু’বার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু কাউকে কোনো জরিমানা করা হয়নি।

প্রকাশ্যে ধূমপান নিরোধে অভিযানগুলো কেন নিয়মিত করা হয় না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটার বিষয়ে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। এসব অভিযান মূলত ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) এবং ডিসি (জেলা প্রশাসক) স্যার পরিচালনা করেন। তাদের সুযোগ এবং সময়ের ওপর নির্ভর করে এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে।

শীর্ষনিউজ