Image description

দ্য স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয়

১২ই ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন এবং একই সঙ্গে জুলাই সনদ নিয়ে একটি গণভোটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সনদের লক্ষ্য হলো নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্গঠন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত করা এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্তেও দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গভীরভাবে অস্থির রয়ে গেছে। এখনও রাজনৈতিক অনেক বিষয় অনিষ্পন্ন অবস্থায়। ভারতের প্রভাবশালী দ্য স্টেটসম্যান ‘আনইজি ভ্যাকুয়াম’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে একথা লিখেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয়ভাবে বর্তমানে বাংলাদেশ এক ধরনের অস্বাভাবিকতার মুখোমুখি। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃত্ব ও দিকনির্দেশনা প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাচ্ছে। আর ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী রাজনীতির প্রধান স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রায় দুই দশক ধরে লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসনে।  তার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে আইনি ও নিরাপত্তাজনিত বাধাগুলো অনেকটাই দূর হয়েছে। উল্লেখ্য, আগামী ২৫শে ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরছেন বলে এরই মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

কিন্তু দেশে চলমান পরিস্থিতি ইসলামপন্থী দলগুলোর জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর জন্য। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্থবিরতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দৃঢ় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে তারা। এর মাধ্যমে তারা এমন এক বয়ান তৈরি করছে, যা দেশের বহুত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক চেতনার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা মধ্যপন্থী রাজনীতির প্রতি জনআস্থা দুর্বল করার চেষ্টা করছে। এতে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং দেশের নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তিকেও আঘাত করা হচ্ছে।

একই সময়ে, কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করা আওয়ামী লীগও তীব্র বিশ্বাসযোগ্যতায় সংকটে পড়েছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাসনে, এবং জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষের সঙ্গে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে না পারায় বর্তমান রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় দলটি প্রায় প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এরই মধ্যে এ দলটির কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

এই শূন্যতা কেবল দলীয় দ্বন্দ্বের বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্র দখলের লড়াই- যে কেন্দ্র ঐতিহাসিকভাবে উদার, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই অনিশ্চয়তাকে আরও ঘনীভূত করছে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান, যারা মধ্যপন্থী-উদার রাজনৈতিক জায়গা দখলের চেষ্টা করছে।

এই নতুন দলগুলো বিএনপির সম্ভাব্য সমর্থনে ভাগ বসাতে চাইছে। আর ভাসমান ভোটাররা গভীর উদ্বেগ নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা নেতৃত্বের দৃশ্যমান উপস্থিতি, রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ও আদর্শিক স্পষ্টতার মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করছে- একটি অত্যন্ত মেরুকৃত পরিবেশে।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির সামনে দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ। একদিকে, কেন্দ্রের দিকে তাদের মনোযোগ দেয়া; অন্যদিকে, নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা। দলটি পূর্বের ইসলামপন্থী মিত্রদের থেকে দূরত্ব তৈরি করে নিজেকে একটি উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। কিন্তু এই কৌশল অনেকটাই প্রতিক্রিয়াশীল- যে দৃঢ়তা ও আগ্রাসী বয়ান নির্মাণ প্রয়োজন, তা এতে অনুপস্থিত।

বিশেষ করে সেই ভাসমান ভোটাররা- যারা ইসলামপন্থী প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত, আবার প্রচলিত দলীয় রাজনীতির প্রতিও সন্দিহান- তারা এখনো বিএনপির ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এর প্রভাব কেবল বাংলাদেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক কেন্দ্র যদি ইসলামপন্থী আধিপত্যের দিকে সরে যায়, তবে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, সীমান্তপারের সহযোগিতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

অন্যদিকে, বিএনপি যদি নিজেদের অবস্থান সফলভাবে পুনর্গঠন করতে পারে এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা বহুত্ববাদকে শক্তিশালী করবে এবং গণতান্ত্রিক মানদণ্ডকে আরও সংহত করতে পারে।

বাংলাদেশ আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। নেতৃত্বের উপস্থিতি, রাজনৈতিক বয়ান নিয়ন্ত্রণ এবং আদর্শিক বিশ্বাসযোগ্যতা- এই তিনটি বিষয়ই নির্ধারণ করবে দেশের ভঙ্গুর রাজনৈতিক কেন্দ্র টিকে থাকবে, নাকি তা চরম মেরুকরণের কাছে নতি স্বীকার করবে।

আগামী কয়েক মাস কেবল কে দেশ শাসন করবে তা নির্ধারণ করবে না; বরং আগামী বহু বছরের জন্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক গতিপথ ও সামাজিক সংহতির ভিত্তিও গড়ে দেবে।