Image description
 

ডলি আক্তারের প্রথম সন্তান শহীদ মুহা. জুনায়েদ হোসেন (২৩)। ছেলে যে আর বেঁচে নেই সেটা বিশ্বাসই হচ্ছে না মমতাময়ী মায়ের। এখনো প্রতি রাতে ছেলের কবরের পাশে গিয়ে চোখের পানি ফেলেন তিনি । ছেলে যে আর কখনোই তার বুকে ফিরবে না—এটা বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন ।

শহীদ জুনায়েদ হোসেনের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের বিলদেওনিয়া গ্রামে। তবে থাকতেন গাজীপুরে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন জুনায়েদ । চাকরি করতেন রাজধানীর মিরপুরে।

আন্দোলনে অংশ নিতে প্রতিদিনের মতো ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বরে চলে যান তিনি। মিছিল-সমাবেশের একপর্যায়ে হঠাৎ পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। এ সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ছোড়া একটি বুলেট জুনায়েদের পিঠ দিয়ে ঢুকে বাম পাঁজর দিয়ে বের হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাকে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সেখানে তার মৃত্যু হয়।

জুনায়েদ চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষে চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরবেন। তবে অর্থাভাবে ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি তার পড়াশোনা হয়নি। মিরপুর-১০ নম্বরে এক কম্পিউটারের দোকানে কাজ করতেন। স্বপ্ন ছিল ভাইবোনকে লেখাপড়া করাবেন; ধুমধামে বিয়ে দেবেন বোনকে; ছোট ভাইকে মাদরাসায় পড়াবেন; করবেন পাকা বাড়ি। কিন্তু আওয়ামী ক্যাডারদের ছোড়া বুলেট শেষ করে দেয় জুনায়েদের সব স্বপ্ন।

জুনায়েদের বাবা শাহ আলম ফরাজি (৫০) জানান, স্বাধীন দেশ দেখার খুব ইচ্ছে ছিল জুনায়েদের। ১৯ জুলাই মাগরিবের নামাজ আদায় করার সময় ঘরে কান্নাকাটির আওয়াজ পাই। নামাজ শেষে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে শুনি, জুনায়েদ গুলি খেয়েছে । কারফিউ থাকায় ঢাকা যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরে তার দোকানের মালিক গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে জুনায়েদের লাশ আমাদের বাড়িতে (গ্রামে) নিয়ে আসেন।

শহীদ জুনায়েদের লাশ বাড়িতে আনলেও পরিবার স্বস্তিতে ছিল না জানিয়ে শাহ আলম বলেন, বাড়িতে আনার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন বাড়িতে এসে এক ঘণ্টার মধ্যে লাশ দাফন করতে বলে। তাদের কথা অনুযায়ী মাটি না দিলে লাশ ছিনিয়ে নেবে বলেও হুমকি দেয়। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। বিদ্যুৎও ছিল না।

বৃষ্টির মাঝেই কবর খুঁড়ে পারিবারিক কবরস্থানে রাত সাড়ে ১১টার দিকে দাফন করি। লাশ দাফনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আমাকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘তোর ছেলে গুলিতে মারা যাওয়ার কথা কাউকে বলবি না, বললে তোর বিরুদ্ধে মামলা হবে; বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে এখান থেকে তাড়িয়ে দেব।’

এদিকে ছেলের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশেও ভয় আর আতঙ্কে দিন পার করতে হচ্ছে শহীদ পরিবারটির। জুনায়েদ হত্যার ঘটনায় মামলা হলেও এখনো কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। উল্টো স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এখনো হুমকি দিয়ে চলেছে বলে দাবি শহীদ পরিবারের। এ বিষয়ে জুনায়েদের বাবা শাহ আলম বলেন, ‘হাসিনার পতনের পর এক শুক্রবার জুমার নামাজে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘যদি জানতাম তোরা বিএনপি-জামায়াত করিস, তাহলে তোদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম।’

মামলা করেও বিপদে আছেন জানিয়ে জুনায়েদের বাবা বলেন, আওয়ামী লীগসমর্থিত রাজনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু আলিম মাদবর, তার ভাই আলমগীর মাদবর, চাচতো ভাই ইকবাল মাদবর, কামাল মাদবর ও সোহেল মাদবর এখনো রাতে ঘরের বেড়ায় আঘাত করে, ভয় দেখায়। হুমকি দেয় মামলা তুলে নিতে। তারা আমার মেজো ছেলের ও আমার হাত-পা কেটে ফেলবে বলে হুমকি দিচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘না পারি মামলা ছাড়তে, না পারি বাড়িতে থাকতে। আগে জানলে মামলা করতাম না।’

জুনায়েদের মা ডলি আক্তার বলেন, ‘যেদিন গুলি খায় সেদিন মাগরিবের নামাজের জন্য ওজু করার সময় জুনায়েদের চাচি এসে বলে, তোমার জুনায়েদ আর নাই। সে গুলি খেয়েছে।’ ‘আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করি। নামাজে বসে আল্লাহর কাছে বলি, আল্লাহ তুমি আমার জুনায়েদকে বাঁচাইয়া দাও। ওর স্বপ্নগুলো শেষ করে দিও না। আমার বুকের মানিকরে আমার কাছে ফিরাইয়া দাও।’ ডলি আক্তার আরো বলেন, ‘সরকার পতন না হলে আমরা বাড়িতে থাকতে পারতাম না। বাড়ি-ঘর সব শেষ করে ফেলত। আমাদের ওপর এখনো অনেক অত্যাচার করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।’

জুনায়েদের বাবা কৃষিকাজ করে কোনো রকমে সংসার চালান। অভাবের সংসারে জুনায়েদের দায়িত্বটা ছিল অনেক বড়। এখন সরকারের কাছে তাদের দাবি, তার পরিবারের একজনকে যেন সরকার চাকরি দেয় ও আর্থিক সহযোগিতা করে। এ ছাড়া তার ছেলেকে যারা শহীদ করেছে তাদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।