Image description
 

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ পেয়েছিল পাঁচ বছরেরও বেশি সময় আগে। এরপর তদন্ত শুরু হলেও এখনো তার ফলাফল আলোর মুখ দেখেনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালী লোক ছিলেন তার বন্ধু, আত্মীয় ও কাছের মানুষ। সেই প্রভাবে এতদিন দুদকেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন গিয়াসউদ্দিন। ‍এছাড়া গোপালগঞ্জের লোক হিসেবে দুদকের কাছ থেকে বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন ‘দায়মুক্তির সনদ’।

শেখ রেহানার বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন গিয়াসউদ্দিন। এছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খানের শ্যালক তিনি। এসব প্রভাব কাজে লাগিয়ে গড়েছেন অবৈধ সম্পদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে নৌপরিবহন অধিদপ্তরে নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার পদে যোগ দেন ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন। যদিও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় যোগ্যতাই তার ছিল না। পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন ‘কমিশন রানী’ খ্যাত শেখ রেহানা ও ফারুক খান তাকে এই পদে বসান। তার পরীক্ষার আবেদনে যে স্বাক্ষরটি রয়েছে, সেটিও তার নিজের নয়। অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৪ সালে এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সে তদন্ত এখনো চলমান।

ক্ষমতার দাপটে বিগত বছরগুলোতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে একাই দায়িত্ব পালন করে গেছেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। ‘কন্ট্রোলার অব এডুকেশন’, প্রিন্সিপাল অফিসার ও সবশেষে চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের চলতি দায়িত্বও তার হাতেই রয়েছে। এসব পদে থেকে তার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ কোস্টাল, ফিশারিজ ও বিদেশগামী জাহাজের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন দেশের নেভিগেশন সার্টিফিকেট অবৈধভাবে জারি করারও অভিযোগ রয়েছে। তার দেওয়া ‘সার্টিফিকেট অব ইকুইভ্যালেন্স’, ‘ইন্দোনেশিয়ার নেভিগেশন সনদ’ ইস্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এছাড়া পানামা, বেলিজ, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার নেভিগেশন সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে।

তাছাড়া সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে অন্তত ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার মাসিক বেতন তিন হাজার ইউএস ডলার বা সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি। ডলারের বর্তমান বাজার রেট হিসাব করলে তার বেতন থেকে আয় পুরো চাকরিজীবনে ৫ কোটি টাকার কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু এ বেতনের বিপরীতে তার সম্পদের ফিরিস্তি শুনলে যে কারো চোখ কপালে উঠবে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ধানমন্ডির ইস্টার্ন ডালিয়ায় রয়েছে ২৫০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট, যার আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা। ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডের বিশ্বাস ক্রিডেন্সে রয়েছে ৩৬০০ স্কয়ার ফিটের আরেকটি ফ্ল্যাট, যেটির বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। একই রোডের রেজাস ড্রিমে ২৪০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, যেটির বাজারমূল্য পাঁচ কোটি টাকা। ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাড়িতে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার ১২০০ স্কয়ার ফিটের আরও একটি ফ্ল্যাট।

 

ad

 

খিলগাঁও প্রধান সড়কের সঙ্গে র‌্যাংগস ভবনে রয়েছে ২৫০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, যার বাজারমূল্য অন্তত পাঁচ কোটি টাকা। উত্তরা স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডে রয়েছে ২৪০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, যেটির বাজারমূল্য আনুমানিক দুই কোটি ৮৮ লাখ। উত্তরা ইস্টার্ন হাউজিং ও জিবিডিএল পার্ক রোডে রয়েছে সমমূল্যের আরও দুটি ফ্ল্যাট। উত্তরার ডমিনোতে (সেক্টর ১১) রয়েছে এক কোটি ৪৪ লাখ টাকার আরও একটি ফ্ল্যাট। মিরপুর ডিওএইচএসে এক কোটি ৬০ লাখ টাকার ২২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। গাজীপুরের পূর্বাচল মেরিন সিটিতে রয়েছে ৫ কাঠার প্লট।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৫ কাঠার প্লট, স্ত্রী সাজেদার নামে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে রয়েছে ‘ওশান মেরিটাইম একাডেমি’ এবং জালিয়াতির কারণে বন্ধ হওয়া ওজিমা মেরিন একাডেমির ৫১ শতাংশ শেয়ার ছিল তার। সূত্র জানায়, গিয়াসউদ্দিন আহমেদের আয় ও সম্পদের এমন তারতম্য নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে তদন্ত শুরু করে দুদক।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার লোহাইড় গ্রামের গ্রাম্যচিকিৎসক মজিবর রহমানের ছেলে মো. গিয়াসউদ্দিন। ১৯৮৮ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ১৯৯২ সালে শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গিয়াসউদ্দিন চাকরিতে যোগদানের আগে গ্রামে তার পরিবারের ৩ বিঘা সম্পদ ছিল। এখন তা বেড়ে কয়েক হাজার বিঘায় দাঁড়িয়েছে। নিজগ্রাম লোহাইড়ে গড়ে তুলেছেন ছয় তলার আলিশান ডুপ্লেক্স ভবন। স্ত্রী সাজেদার বাবা সাবেক ডিস্ট্রিক্ট কানুনগো ও বড় শ্যালক মোখলেছুর রহমান লিটন ঢালী পরিবারেও আজ অর্থবিত্তের শেষ নেই। ধানমন্ডিতে ‘ভূতের আড্ডা’ নামে রেস্তোরাঁ রয়েছে তার।

গিয়াসউদ্দিক পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের বাল্যবন্ধু, সাবেক মন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানের শ্যালক হওয়ায় দুহাতে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

এছাড়াও অভ্যন্তরীণ কোস্টাল, ফিশারিজ ও বিদেশগামী জাহাজের বিভিন্ন গ্রেডে চাকরিরত মাস্টার, নাবিকদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে লাখ লাখ টাকা উপার্জনেরও অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। গিয়াসউদ্দিনের পরিবারের দখলে রয়েছে ব্লাক প্রিমিও ব্রান্ডের প্রাইভেটকার, লেটেস্ট ব্র্যান্ডের দুটি এক্স করলা ও দুটি নোয়া মাইক্রো। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দপ্তরে এসব বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেন এক ভুক্তভোগী।

অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালের ‘ডামি নির্বাচনে’ গিয়াসউদ্দিন স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সক্রিয় সদস্য এবং জুলাই-আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরাসরি বিরোধী ছিলেন।

অভিযোগের বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম আমার দেশকে বলেন, ‘আমি এ দপ্তরে এসেছি দেড় বছরের মতো হয়েছে। গিয়াসউদ্দিন আহমেদের বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে। দুদকের বিষয়ে কোনো কিছু জানি না। আমার কাছে দুদকের কোনো লোক আসেনি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠালেও ফিরতি কোনো জবাব দেননি।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আমার দেশকে বলেন, কোনো অপরাধীকে আমরা ছাড় দেব না। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা এসেছি পরিষ্কার করতে। কোনো অপকর্ম করে কেউ ছাড় পাবে না।