২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ডিজিটাল পরিসরে রাজনৈতিক ‘ভুয়া খবর’ বা ‘কুতথ্য’ (ডিসইনফরমেশন) ছড়ানোর বিষয়টি যখন কেবল কিছু বেনামী ফেসবুক পেইজে সীমাবদ্ধ ছিল, তখন প্রথম এই কাজটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপে শুরু করে বাংলা ইনসাইডার নামক একটি ওয়েবসাইট। আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক সৈয়দ বোরহান কবীরের মালিকানাধীন কোম্পানি ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেড এই বাংলা ইনসাইডার ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করতো।
বোরহান কবীরের সম্পাদনায় ২০১৭ সাল থেকে পরিচালিত ‘বাংলা ইনসাইডার’ (banglainsider.com) আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং তখনকার বিরোধী মতের বিপক্ষে নানান ধরনের ভুয়া খবর ও কাল্পনিক খবর উৎপাদন করে প্রকাশ করতো।
পোর্টালটি থেকে সাবেক পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তি, জাতিসংঘের পুরস্কার প্রাপ্তি, বিশ্বের সৎ প্রধানমন্ত্রী, বিশ্বের সবচেয়ে কর্মঠ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইত্যাদি কাল্পনিক সংবাদ কাল্পনিক বিভিন্ন সংস্থার ‘গবেষণা’ বা ‘জরিপ’ আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে পুরো বছরজুড়ে মূলত শেখ হাসিনার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক ভুয়া খবর ছড়িয়েছিল পোর্টালটি। এরকম একটি ভুয়া খবর বাংলা ইনসাইডারে ছড়ানো হয়েছিল যেটিতে দাবি করা হয়েছিল, “অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের ডেকান ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর হিউম্যান লিডারশীপ-২০১৭ মানবতার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম প্রকাশ করেছে”। এই ভুয়া খবরের প্রেক্ষিতে পরে জাতীয় সংসদে আলোচনা হয় এবং আলোচনার প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সংসদ অধিবেশনেই বলেন, “আমি এটুকু বলতে চাই, কি পাইনি সে হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি। কি পেলাম, কি পেলাম না সে হিসাব মেলাতে আমি আসিনি। দেশের মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য আমি কাজ করি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব বিশ্লেষণ তাঁর ওপর কোন প্রভাব ফেলেনা।”
এরকম শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলা ইনসাইডার-এর ছড়ানো বহু ভুয়া খবর বিবিসি বাংলা, এএফপি সহ একাধিক সংবাদমাধ্যম ও ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা বিভিন্ন সময়ে খণ্ডন করেছে।
বাংলা ইনসাইডারের ছড়ানো এসব ভুয়া খবর ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাগুলো খণ্ডনের পরও পরবর্তী বছরগুলোতে নিয়মিত ফেসবুকে ছড়িয়েছে।
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং এটির ফেসবুক ও অন্যান্য সোশাল মিডিয়া একাউন্টগুলোও ডিলিট করে দেয়া হয়েছে। তকে ইন্টারনেট আর্কাইভ থেকে দ্য ডিসেন্ট বিগত সময়ে ছড়ানো কিছু প্রতিবেদন পুন:রুদ্ধার করেছে। এসব প্রতিবেদনের মধ্যে অতীতে ফ্যাক্ট চেকাররা যেগুলোকে ভুয়া খবর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সেগুলোর কয়েকটিকে এই প্রতিবেদনে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে।
ভুয়া খবরের ‘কারখানা’ বাংলা ইনসাইডার
ওয়েব্যাক আর্কাইভ থেকে বাংলা ইনসাইডার এর ছড়ানো ১৮টি ভুয়া সংবাদ প্রতিবেদন উদ্ধার করতে পেরেছে দ্য ডিসেন্টঅ এগুলোর বেশিরভাগই শেখ হাসিনার পক্ষে ভুয়া আন্তর্জাতিক জরিপ কিংবা পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে ছড়ানো ভুয়া সংবাদগুলোর কোন কোনটি এখনও ফেসবুকে ছড়ায়। এরমধ্যে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ‘বিডিফ্যাক্টচেক’ সাতটি, ‘যাচাই ডট ওআরজি’ পাঁচটি এবং অন্যান্য ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান বাকিগুলোকে ভিত্তিহীন সাব্যস্ত করেছে।

বাংলা ইনসাইডার এর ডিলিট করা ওয়েবসাইট থেকে উদ্ধার করা শেখ হাসিনা সম্পর্কে ছড়ানো কয়েকটি ইতিবাচক ভুয়া খবরের চিত্র
২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর ‘বাংলা ইনসাইডার’ ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ নামক একটি অস্তিত্বহীন কাল্পনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে তৃতীয় সৎ সরকারপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ঘটনায় তখন শেখ হাসিনাকে জাতীয় সংসদে অভিনন্দন জানানো হয়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাসহ সংবাদমাধ্যমগুলো এটি নিয়ে প্রতিবেদন ছাপে। এটি নিয়ে ফ্যাক্টচেক দেখুন এখানে। আদতে এ নামে কোনো গবেষণা সংস্থার-ই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সংবাদটিতে বলা হয়, “পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস বিশ্বের ৫ জন সরকার রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি, বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদও নেই।”
“শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের ৭৮ ভাগ মানুষ মনে করেন সৎ এবং ব্যক্তিগত লোভ লালসার উর্ধ্বে বলে সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে”, কাল্পনিক প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
কাল্পনিক গবেষণা সংস্থাটির সূত্রে নানা সময়ে শেখ হাসিনার বৈশ্বিক পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে ছয়টির বেশি ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করে পোর্টালটি। সংবাদগুলোর উপর ভিত্তি করে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কিছুদিন পর পর প্রচার করা হয়।
২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রচার করা হয়, জনপ্রিয় সরকার প্রধানদের শীর্ষ দশে শেখ হাসিনা। এতে দাবি করা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘পলিটিক্স অ্যান্ড পিপলস’ এর সর্বশেষ তালিকায় বিশ্বের সপ্তম জনপ্রিয় সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।”

বাংলা ইনসাইডার এর ছড়ানো ভুয়া খবর ফেসবুকে
কাল্পনিক কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে আরো উল্লেখ করা হয়, “গবেষণায় এসেছে- শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া। তাঁকে আধুনিক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। বাংলাদেশে নতুন রূপকথার নায়ক তিনি।”
শেখ হাসিনা: বিশ্বের সবচেয়ে মিতব্যয়ী সরকারপ্রধান শিরোনামের আরেকটি ভূয়া প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সরকার প্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে চলেন। পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স এর গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছ।” ভুয়া এই সংবাদ প্রকাশের পর ফেসবুকে ব্যাপকভাবে অভিনন্দন জানানো হয় শেখ হাসিনাকে।
অস্তিত্বহীন পিপলস এন্ড পলিটিক্স সংস্থার নামে পোর্টালটি থেকে ছড়ানো কিছু প্রতিবেদন- ‘শেখ হাসিনা: বিশ্বে চতুর্থ কর্মঠ সরকারপ্রধান’; ‘বিশ্ব নেতার সংক্ষিপ্ত তালিকায় শেখ হাসিনা’; ‘বিশ্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবচেয়ে বিচক্ষণ নেতা বিবেচিত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’।

বাংলা ইনসাইডার এর ছড়ানো ভুয়া খবর ফেসবুকে
শেখ হাসিনা: বিশ্ব মানবতায় চ্যাম্পিয়ন নামে আরেকটি ইতিবাচক কাল্পনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “পোপ ফ্রান্সিস এবং বিল গেটসকে পিছনে ফেলে ২০১৭ সালে বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক মানুষ মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা”। এটি নিয়ে জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনাকে অভিবাদন জানানো হয়। এটিকে ভিত্তিহীন সাব্যস্ত করে ফ্যাক্টচেক দেখুন এখানে
২০১৭ সালে শান্তিতে শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে একগুচ্ছ ভিত্তিহীন সংবাদের অবতারণা করেছিল বোরহান কবীরের বাংলা ইনসাইডার পোর্টালটি।
একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, নোবেল শান্তি পুরস্কারে শর্টলিস্টে শেখ হাসিনার নাম এসেছে। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলের সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনয়ন পেয়েছেন শেখ হাসিনা। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, নোবেল শান্তিতে সংক্ষিপ্ত তালিকায় শেখ হাসিনার নাম এসেছে।
‘জাতিসংঘে দুটি পুরস্কার পাচ্ছেন শেখ হাসিনা’ শিরোনামে খবরে বলা হয়, শিক্ষা এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান আর সামাজিক উন্নয়নে উদ্ভাবনী কর্মসূচি গ্রহণের জন্য শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে সাধারণ পরিষদের ৭২ তম অধিবেশনে।
“নোবেল শান্তি কমিটি ১০ বিশেষজ্ঞের কাছে মতামত চেয়েছে, তারমধ্যে চারজনই শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করেছে। নরওয়ের একাধিক সূত্রে বাংলা ইনসাইডার এটি জানতে পেরেছে”, একটি প্রতিবেদনে বলা হয়।
কাল্পনিক প্রতিবেদনগুলোর ধারাবাহিকতায় “নোবেল শান্তি পুরস্কার: শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব” শিরোনামে আরেকটি ভুঁইফোড় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর এটি ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অভিনন্দন বার্তায় ভরে যায়। অথচ পুরো বিষয়টি ছিল মিথ্যা, বানোয়াট।
আরেকটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, নোবেল শান্তি পুরস্কারে জাতিসংঘের পছন্দ শেখ হাসিনা।
এখানে উল্লেখ করা হয়, “ইনসাইডারকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সহ একাধিক সংস্থা এবছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য পছন্দের তালিকায় শেখ হাসিনার নাম রেখেছেন।”
এর পরবর্তী আরেকটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, “নোবেল শান্তি কমিটি শেখ হাসিনা, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেলকে যৌথভাবে নোবেল দেওয়ার কথা ভাবছে। পুরস্কার ঘোষণার দিন শেখ হাসিনা কোথায় থাকবেন সেটি খোঁজ নিচ্ছে বৈশ্বিক মিডিয়া।”
উপরের প্রতিবেদনগুলোসহ শেখ হাসিনাকে নিয়ে ১৮টির বেশি কাল্পনিক প্রতিবেদন সৈয়দ বোরহান কবীরের বাংলা ইনসাইডার পোর্টাল থেকে উদ্ধার করা গেছে।
এমন আরও কয়েকটির শিরোনাম হলো, “হার্ভার্ডে শেখ হাসিনা চর্চা”, “শেখ হাসিনা নতুন মাহাথির” কিম্বা “বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নারী শাসক শেখ হাসিনা” ইত্যাদি।
বিরুদ্ধ মতের চরিত্র হনন করতে কাল্পনিক খবর
সাংবাদিক সৈয়দ বোরহান কবীরের বাংলা ইনসাইডার থেকে একদিকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ইতিবাচক কাল্পনিক প্রচারণা চালানো হয়েছে, অন্যদিকে বিরুদ্ধ মতের ব্যক্তিদের নামে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।
২০২৩ সালে পোর্টালটি থেকে ‘এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন’ আকারে ছড়ানো হয় একটি ভুয়া খবর যার শিরোনাম ছিল, “ইসরায়েলকে ১০০ কোটি টাকার সহায়তা দিলেন ড. ইউনূস”। পুরোপুরি ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘গাজা যখন জ্বলছে তখন ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ালেন নোবেলজয়ী ইউনূস’। এটিকে তখন ভুয়া সাব্যস্ত করেন ফ্যাক্টচেকাররা। পাঁচ আগস্টের পর ফেসবুকে এটি আবারও ছড়ানো হয়।
এএফপি ২০২৩ সালে বাংলা ইনসাইডার এর এই ভুয়া খবরটি খণ্ডন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

তারেক রহমানকে নিয়ে ছড়ানো বাংলা ইনসাইডার এর ভুয়া খবর
২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলা ইনসাইডারের ইংরেজি ভার্সনে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দাবি করে, তারেক রহমান বিশ্বের অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের তালিকায় ১৭তম স্থানে আছেন। তারা উল্লেখ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘Peace and Conflict’–এর ২০১৫ সালের ‘Arms Dealers around the World’ শীর্ষক রিপোর্টে এই তথ্য রয়েছে। এক বছর পর, ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর, কোনো নতুন তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই একই অভিযোগ নতুন করে তাদের বাংলা ভার্সনে প্রকাশ করা হয়, ‘অস্ত্র ব্যবসায়ী তারেক জিয়া’।
তবে বিডিফ্যাক্টচেকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই খবরটি ভুয়া। বাংলা ইসাইডার এর প্রতিবেদনে উদ্ধৃত ‘Arms Dealers around the World’ রিপোর্ট, ‘Peace and Conflict’ নামে কোনো US-based গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।
সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা ভিন্নভাবে
বর্তমানে বাংলা ইনসাইডার বন্ধ থাকলেও এবং বোরহান কবীর ‘পলাতক’ থাকলেও তার মালিকানাধীন ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের ফেসবুক পেইজ এবং ইউটিউব একাউন্ট ৫ আগস্টের পর নতুনভাবে সক্রিয় হয়েছে। নিয়মিত বিরতীতে পোস্ট করা হচ্ছে ভিডিও।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচয় ‘বিজ্ঞাপনী সংস্থা’ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে এবং ইউটিউবে ‘পর্যবেক্ষণ’ নামে সাংবাদিকতামূলক কন্টেন্ট প্রকাশ করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ২৩ আগস্ট ‘পর্যবেক্ষণ’ নামে নতুন আঙ্গিকে কন্টেন্ট প্রচার শুরু করা হয়েছে। চ্যানেলটিতে বেশ কয়েকটি ভিডিও ইন্টারভিউর মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির মতামত প্রকাশ করা হয়েছে।

বর্তমানে ইউটিউবে সক্রিয় সৈয়দ বোরহান কবীরের ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেড এর একাউন্ট
এতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মামুন রশীদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, যুবলীগ নেতা ও সাংবাদিক শেখ জামাল প্রমুখসহ মোট ১৭টি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়েছে।
সাক্ষাৎকারগুলোতে ‘মব কালচার’, ‘মিথ্যা মামলা’ নিয়ে ইত্যাদি সমসাময়িক নানা ইস্যুতে কথা বলতে দেখা গেছে সাক্ষাতকারদাতাদের।
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের মিডিয়া উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের সাক্ষাৎকারের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘৫ আগস্টের পর অনেক মিথ্যা মামলা থানায় হয়েছে - মুহাম্মদ তালেবুর রহমান - মুখপাত্র, ডিএমপি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রৌবায়েৎ ফেরদৌসের সাক্ষাৎকার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে- ‘মব কীভাবে গড়ে ওঠে?’, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘মিথ্যা মামলাগুলো অভ্যুত্থানের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে’। আরও কয়েকটি শিরোনাম, ‘বিচারব্যবস্থায় আস্থা হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ’, ‘উপদেষ্টারা শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের মতো কথা বলা শুরু করেছেন: ড. দেবপ্রিয়’; ইত্যাদি।
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেড নামে একটি ফেসবুক পেইজ এবং ইউটিউব একাউন্ট দুটোই ২০১৪ সালে তৈরি করা। ফেসবুক পেইজে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট লিংক সংযুক্ত থাকলেও সেটি বর্তমানে বন্ধ পাওয়া যায়।
বাংলা ইনসাইডার পোর্টালটিকে ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তথ্য মন্ত্রণালয় নিবন্ধন প্রদান করে। হো ইজ ডটকম-এ সার্চ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১১ অক্টোবর বাংলা ইনসাইডার পোর্টালটির নিবন্ধন নেওয়া হয়। আর্কাইভ করা পোর্টালটির নিচে উল্লেখ রয়েছে, ‘এটি ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান’। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সৈয়দ বোরহান কবীর।
কে এই বোরহান কবীর?
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচারিত ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সৈয়দ বোরহান কবীর সাংবাদিকতার জগতে পরিচিত হন। তিনি সাংবাদিক কাজী শহিদ আহমেদ সম্পাদিত আজকের কাগজ ও মতিউর রহমানের সম্পাদিত দৈনিক ভোরের কাগজে প্রতিবেদক ছিলেন।
১৯৯৬ সালে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন অসাংবিধানিক ও সেনা সদস্যরা নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করেছেন শীর্ষক প্রতিবেদন করায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৮ সালে প্রতারণার একটি মামলায় তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ আসার পর ‘শেখ হাসিনা ফ্রম লিডার টু স্টেটসপারসন’ বই প্রকাশ করে পালটে যায় তার জীবন। এরপর ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেড নামে বিজ্ঞাপনী সংস্থা শুরুর পরই এটির অধীনে ২০১৭ সালে বাংলা ইনসাইডার নামে পোর্টালটি চালু করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পক্ষে মতামত নিবন্ধ লিখতেন তিনি।
২০২৪ সালের পাঁচ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২২ সালের ভিত্তিহীন প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানহানির অভিযোগে দায়েরকৃত একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। তবে তিনি আদালতে হাজির না হওয়ায় গত ২৮ আগস্ট তার নামে পত্রিকায় পলাতক বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এর আগে গত ২০২৪ সালের অক্টোবরে অন্য ২৮ সাংবাদিকের সঙ্গে অ্যাকাউন্টের তথ্য জানতে চেয়েছে বিএফআইইউ। এ সময় তার প্রেস অ্যাক্রিডেশন কার্ড বাতিল করা হয়।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর সৈয়দ বোরহান কবীরের স্ত্রী অদিতি করিম এর নামে দেশের মূলধারার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে মতামত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনের জন্য সৈয়দ বোরহান কবীরের গ্রামীণফোন নম্বরে যুক্ত হোয়াটসঅ্যাপে কল করলে তিনি রিসিভ করে পরিচয় জানতে চান। দ্য ডিসেন্ট এর পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে, ‘আমি কথা বলবো না’ বলে ফোন কেটে দেন।
এরপর তার গ্রামীণফোন নম্বরে সরাসরি কল দিলে রিং হয়েছে, তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।