Image description
স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য

ঋণের উচ্চসুদ, মিলছে না গ্যাস, বিদ্যুতের চড়া মূল্য, নিয়ন্ত্রণে নেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পরিবহণ ব্যবস্থা। সবকিছু মিলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যেন পুরো স্থবির। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ অবস্থায় স্থানীয় বিনিয়োগ। ব্যবসা-বাণিজ্যে খারাপ অবস্থা থাকলেও করের বোঝা বাড়ছে। ব্যবসায়ী থেকে জনগণ সবার কাঁধেই বোঝার ভার। এদিকে প্রতিবারের মতো এবারও রাজস্ব আদায় পিছিয়ে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

অপরদিকে, আদায়ে পিছিয়ে থাকলেও এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ৫৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে আরো ৫৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে সরকার। অবশ্য আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করতে সরকারের এই উদ্যোগ ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন চাপ তৈরি করবে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। একই সঙ্গে সংস্কারের পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ তাদের।

ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আর্থিকখাতের বিশ্লেষক প্রফেসর আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। ঋণের উচ্চ সুদ বিরাজমান। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ নেই। এমনকি আগামী দিনে এ থেকে উত্তরণ ঘটবে সেই পদক্ষেপও নেই। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীদের ওপর করের চাপ বাড়ানো অযৌক্তিক বা ‘মরার ওপর খড়ার ঘা’। কর বাড়াতে এনবিআরকে দ্রুত বিকল্প পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সূত্র মতে, দেশের উন্নয়ন ও সরকার পরিচালনার ব্যয়ের যোগান দিতে জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় এনবিআরকে, পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থবছরের মাঝামাঝিতে তা কমাতে হয়েছে প্রতিবারই। এবার ঘটেছে উল্টো ঘটনা; প্রথমবারের মতো লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মূলত আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ সফরকালে রাজস্ব আহরণ নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ জানালে ভাবতে শুরু করে সরকার। পরে গেল নভেম্বরে দুই বিশেষ সভা শেষে বাড়ানো হয় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এতে আগের চেয়ে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। অথচ বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি রয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।

তথ্য বলছে, আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক আদায় লক্ষ্যমাত্রা ১৪ হাজার কোটি, ভ্যাটে ২০ হাজার ৩৫০ কোটি আর আয়করে বাড়ানো হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।
উদ্বেগ প্রকাশ করে বাঁধন ফ্যাশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, রাজস্ব যে বাড়াবেন সেটা বাড়ানোর ক্ষেত্রে আপনার চিন্তা কী, আপনি কি ব্যবসায়ীদের থেকে আদায় করবেন, অন্যান্য খাতে ট্যাক্সের পরিধি বাড়াবেন? পরিধি বাড়ালে ব্যবসায়ী ও শিল্পের ওপর প্রভাব পড়বে। সেটা কিন্তু আমাদের জন্য সহনীয় হবে না।
অথচ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার মধ্যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা আরো বাড়ানো হয়েছে। যা আরো চাপে ফেলবে ব্যবসায়ীদের। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশ কিছু সংস্কারেরে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এনবিআরে। বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এসব সংস্কার আর প্রযুক্তির সমন্বয়কে কাজে লাগানোর তাগিদ প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমানের। গেল অর্থবছরে দুই দফায় কমিয়েও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি এনবিআর। এমনকি আগামী দিনের এ অবস্থায় সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের থান কাপড় ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। একরকম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই দিন পার করতে হচ্ছে তাদের। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও লাভের মুখ দেখছেন না তারা। দিনে ১০০ টাকাও বেচাকেনা হচ্ছে না অনেকের। অথচ একসময় দৈনিক ৩০-৪০ কোটি টাকার বেচাকেনা হতো এখানে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করতেন মার্কেটের ব্যবসায়ী ও সাধারণ শ্রমিকরা। বর্তমানে মালিক-শ্রমিকদের গল্প-গুজব করে অলস সময় কাটে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব ধরনের গেঞ্জির থান কাপড়ের অন্যতম পাইকারি ও খুচরা বিক্রির মার্কেট হলো নারায়ণগঞ্জ শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকার রেলওয়ে সুপার মার্কেট। মার্কেটের পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের দোকান রয়েছে। আগে এই ব্যবসা অল্প পুঁজিতে করা গেলেও এখন আর সে অবস্থা নেই। দোকানভেদে ১০ লাখ থেকে কয়েক কোটি টাকার মাল রয়েছে। এখান থেকে নারায়ণগঞ্জের শিল্প নগরী বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকার গার্মেন্টস মালিকরা থান কাপড় সংগ্রহ করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলওয়ে সুপার মার্কেট ও সংশ্লিষ্ট প্রায় দেড় হাজার দোকান রয়েছে। আর এই দোকানগুলোর সঙ্গে আট থেকে ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। তবে বর্তমানে তারা কেউই ভালো নেই।

নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী সাইদ হোসেন বলেন, ব্যবসার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। বেচাকেনা একেবারেই কম। সারাদিন বসে থাকতে হয়। যাদের কাছে মালামাল বিক্রি করা হয়, তারা ঠিকমতো কারখানা চালাতে পারছেন না। আগে ক্রেতাদের আনাগোনায় মার্কেট সরগরম থাকতো। এখন কোনো কাজ নেই। কর্মচারীরা বসে থাকে। এরকম হবে কেউ ধারণাও করতে পারেননি। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিদেশেও বেচাকেনা খারাপ যাচ্ছে।

মহিবুল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক মো. লুৎফর রহমান লিটন বলেন, বিগত ২৭ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। বিগত সময়ে এই সময়ে অনেক বেচাকেনা হতো। এখন বেচাকেনাই নেই। সিজন চলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ চাপে রয়েছে এবং সরকারের নীতি অবস্থান ব্যবসাবান্ধব নয়। তিনি অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে সমস্যার কথা জানালেও সরকার তা আমলে নিচ্ছে না।

আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আমরা চিৎকার করলেও সরকার শুনছে না। তারা ব্যবসায়ী মহলকে কেয়ার করছে না। জ্বালানির দাম বাড়িয়েও সরকার স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের পর থেকেই জ্বালানিসংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসে অটোরিকশা চালাচ্ছেন, ফলে রাজধানীর জনসংখ্যা সাড়ে তিন কোটিতে পৌঁছেছে। খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে বিসিআই সভাপতি বলেন, ১৭ শতাংশ ঋণ খেলাপি থাকার সময় আইএমএফ বাংলাদেশকে ‘মধ্যম মানের ঝুঁঁকিপূর্ণ’ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এখন খেলাপি ঋণ ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

প্রতিকূল অর্থনৈতিক বাস্ততায় তাই নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জিং বলছেন অর্থনীতিবিদরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একটা বিপজ্জনক এবং বাধ্যতামূলক পরনির্ভরশীলতার মধ্যে আমরা পড়ে যাচ্ছি। একটা ঋণ নির্ভরতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। আমরা মধ্যম আয়ের ফাঁদের দিকে পড়ে যেতে পারি। সুতরাং সেদিক থেকে আমাদেরকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বাড়াতে হবে।