Image description

বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান। প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কাজ করছেন সেখানে। বৈধ কর্মীদের বীমা সুবিধা থাকায় দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে এককালীন ১৫ হাজার রিয়াল (বাংলাদেশি টাকায় অর্ধকোটি) মৃতের ওয়ারিশরা ক্ষতিপূরণ বাবদ পেয়ে থাকেন। কিন্তু ওমান এবং বাংলাদেশের একটি চক্র ইন্স্যুরেন্সের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কৌশলে মৃত ব্যক্তির পাসপোর্ট, মেডিকেল সনদ হাতিয়ে নিয়ে এবং ওয়ারিশদের থেকে ভুয়া আমমোক্তারনামা দেখিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে ইতিমধ্যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। বাংলাদেশে এ চক্রের মূলহোতা ভোলার লালমোহন উপজেলার মো. সবুজ। তিনি রমাগঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কর্তারহাট বাজার এলাকার আব্দুল মালেকের ছেলে।

সূত্র মতে, কৃষক বাবার তিন ছেলের মধ্যে মেজো সবুজ। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল। বাধ্য হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তাকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে পাঠিয়ে দেয় পরিবারের লোকজন। ২০০৮ সালে ধারদেনা করে তাকে ওই দেশে পাঠান তার বাবা। সেখানের এক আইনজীবীর গাড়িচালক হিসেবে চাকরি শুরু করেন সবুজ। এ থেকে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তার টার্গেট হয়ে ওঠে লাশ। বাংলাদেশি যেসব কর্মী ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তাদের লাশ নিয়ে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিতে শুরু করেন লাখ লাখ টাকা। এভাবেই নিজের ভাগ্য বদলেছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলেই সবুজের নেতৃত্বে প্রতারক চক্র হয়ে ওঠে ওই মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন। বর্তমানে তিনি লাশের টাকা আত্মসাৎ করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন কোটি টাকার রাজপ্রাসাদ। এ ছাড়া, নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। দেশে থেকে সবুজের প্রতারণার কাজে সহযোগিতা করেন তার শ্বশুর মো. মাকসুদুর রহমান। তিনি উপজেলার লর্ডহাডিঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদপুর এলাকার বাসিন্দা। এসব ঘটনায় এরইমধ্যে সবুজের নামে প্রতারণার তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে দু’টি এবং সিলেটের হবিগঞ্জে একটি।

সবুজের প্রতারণার শিকার হয়ে চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করেছেন মো. আরিফ নামে এক যুবক। আরিফ চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার দক্ষিণ সর্ত্তার গ্রামের বাসিন্দা। ওই মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ২০২১ সালের ১২ই ডিসেম্বর কর্মরত অবস্থায় ওমানের মাসিরা নামক এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তার বাবা নূরুল আবছার। এরপর দেশে এনে লাশ দাফনের পর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করেন। ওই আবেদনের পর ২০২৪ সালের ২৯শে নভেম্বর সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানানো হয় সবুজ নামে এক ব্যক্তি ওমানের আইনজীবী সুলাইমান আল বুসাইদির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের ৪৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। ওই আইনজীবীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জালিয়াতি করে টাকা উত্তোলন করেন সবুজ। মামলার বাদী আরিফ জানান, সবুজ প্রতারণা করে আমার বাবার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করেছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। ওই মামলায় বর্তমানে সবুজের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।  

একই অভিযোগে সবুজ এবং তার শ্বশুর মো. মাকসুদুর রহমানসহ আরও কয়েকজনের নামে চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরেকটি মামলা করেছেন মো. খোরশেদ আলম নামে এক ব্যক্তি। তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চেংখালি এলাকার দুদু মিয়ার ছেলে। মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, তার ছেলে ওমর ফারুক রনি ২০২৪ সালের ৪ঠা মার্চ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে দুই লাখ টাকা ধারদেনা করে ছেলের লাশ দেশে এনে দাফন করেন। ওমান ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সমন্বয়ে ওমানের আইনজীবী সাইফ আল বুসাইদির মাধ্যমে ১৫ হাজার ১৩০ ওমানি রিয়াল রনির বৈধ ওয়ারিশদের প্রদান করতে বলা হয়। তবে আইনজীবী সাইফ আল বুসাইদি ও সবুজ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তৈরি করে ক্ষতিপূরণের ১১ হাজার ২০০ ওমানি রিয়াল যা বাংলাদেশি ৩৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। মামলার বাদী মো. খোরশেদ আলম বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি নিশ্চিত হন। তিনি ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরত পেতে ও আসামিদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। 

এ ছাড়া, হবিগঞ্জেও নিজের প্রতারণার জাল বিছিয়েছেন মো. সবুজ। ফলে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালতেও একটি প্রতারণার মামলা করেছেন মো. স্বপন মিয়া নামে এক ব্যক্তি। স্বপন মাধবপুর উপজেলার বহরা ইউনিয়নের বহরা গ্রামের মো. লোকমান মিয়ার ছেলে। মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, তার ভাই মো. ফুল মিয়া ২০১৯ সালের ১৫ই জুলাই ওমানের মাস্কাটে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ক্ষতিপূরণ বাবদ বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয় সবুজ এবং ওমানের আইনজীবী সাইফ আল বুসাইদি চক্র মিলে ক্ষতিপূরণের ৪৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। 

এসব বিষয়ে জানতে সবুজের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে দেখা মিলেছে তার প্রতারণার টাকায় গড়া রাজপ্রাসাদের। অন্তত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তার ওই রাজপ্রাসাদ। কথা হয় তার স্ত্রী ইফফাত আরা তিন্নির সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্বামী ২০০৮ সালে বিদেশে যান। সেখানে একজন আইনজীবীর গাড়িচালক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন পান। তার জমানো টাকা দিয়ে এই বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই বাড়িটিই এখন আমাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মামলার বিষয়ে বলেন, সব বিষয়েই আমি জানি। আমার বাবা আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। আর আমার স্বামী বর্তমানে ওমানে আছেন। তাকে কিছু লোক ফাঁসিয়েছে।

সবুজের বাবা আব্দুল মালেক বলেন, আমার ছেলে সবুজ নাকি লাশের টাকা আত্মসাৎ করেছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়েছে। বিষয়টি শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে। আমি ছেলের থেকে কখনো এমনটা আশা করিনি। আমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করি। তার দোতলা ভবনের নিচতলা আমার মাধ্যমেই নির্মাণ করা হয়েছে। ওই সময় আমার কাছে টাকা দিয়েছে। তবে দ্বিতীয়তলা নির্মাণের সময় আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। সব কাজ তার শ্বশুরকে দিয়ে করিয়েছে। শ্বশুর মো. মাকসুদুর রহমান জানান, আমরা মামলা মোকাবিলা করবো। যা হওয়ার তা মামলার রায়েই হবে। অভিযোগের বিষয়ে সবুজ মুঠোফোনে বলেন, এসব কাজের সঙ্গে আমি জড়িত নই। হবিগঞ্জের যে মামলা ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। বাকি মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেষ করবো।

লালমোহন থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, সবুজ একজন বড় ধরনের প্রতারক বলে আমরা জেনেছি। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে মৃত বাংলাদেশি কর্মীদের মরদেহের ক্ষতিপূরণের অর্থ হাতিয়ে নেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলাও হয়েছে। আমাদের থানায় একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি।