বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে’। তিনি মূলত আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কার কথা বলেছেন। তার এই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। নেটিজেনরা এ বক্তব্যকে সময়োপযোগী এবং যথার্থ হিসেবে অভিহিত করছেন। বিবিসি বাংলাকে দেয়া মির্জা ফখরুলের সাক্ষাৎকারটি শুনে-এবং পড়ে মনে পড়ে গেলে ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এস এম শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ সিনেমার সাবিনা ইয়াসমিনের ‘গিতিময়, সেইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না’ গানের কথা। তাহলে কি ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের ঐক্যের ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছে? গত ৫ মাস ভারতের সবধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছে ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ভাবে। প্রধান উপদেষ্টার ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবানে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করেছে। সেই ঐক্যের ছন্দে কী ফাটল ধরতে যাচ্ছে?
শত শত ছাত্রজনতার রক্তের বিনিময়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অর্জিত হয়েছে। ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশা গুম-খুন-গণতন্ত্র হত্যার দায়ে এ যুগের ঘসেটি বেগম ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার হবে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় নেয়া হবে। পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনা হবে। হাসিনার অলিগার্কদের বিচার হবে শাস্তি হবে। পাশাপাশি কিছু সংস্কার করে ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ শ্লোগান তুলে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু দেশের সর্ববৃহৎ দল বিএনপির মহাসচিবের এই বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে ‘ডাল মে ক্যুচ কালা হ্যায়’। পর্দার অন্তরালে ‘যাকে খুশি তাকে ভোট দেব’ ভাবাবেগের বাইরে ভিন্ন কিছু হচ্ছে। সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করা, আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে ‘কিংস পার্টি’ গঠন, দিল্লির নীল নকশা ও পতিত হাসিনার প্রত্যাশা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের জুলুম-নির্যাতন-লুটপাট-চাঁদাবাজির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ৫ মাস সময়ে বিএনপিকে ইংগিত করে চাঁদাবাজির দায় চাপিয়ে ‘এক চাঁদাবাজকে হটিয়ে আরেক চাঁদাবাজ ক্ষমতায় আনার জন্য নয়’ এমন ফরমায়েশি অভিযোগ প্রচার করা এবং একটি দলের অনুসারী কিছু মওলানার ‘ইসলামী জলসা-ওয়াজ মাহফিলে’ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজ’ তকমা দেয়ার মতো কাÐজ্ঞানহীন বক্তব্য স্বাভাবিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে তুলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচন করেছে; অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা ক্ষমতার চেয়ারে থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে প্রার্থী হলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আর অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে পার্থক্য কী থাকছে?
বিবিসি বাংলা সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়, এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে এবং নির্বাচন পর্যন্ত তো এই সরকারের মেয়াদ থাকবে, এটাই সবার ধারণা? জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যদি সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কনডাক্ট করা পর্যন্ত থাকবেন। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে’। পরের প্রশ্ন ‘আপনার কি ধারণা যে, এই সরকারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে?’ জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আসতে পারে। কেননা, এখানে আমরা জিনিসটা লক্ষ্য করছি যে, আপনার ছাত্ররা তারা একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার কথা চিন্তা করছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এই সরকারে থাকে, তাহলে তো এই সরকার নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। ওইটা হচ্ছে, সম্ভাব্য কথা। কিন্তু যদি তারা মনে করে যে, (সরকারে) থেকেই তারা নির্বাচন করবেন, তাহলে তো রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না’। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা বলছেন, মির্জা ফখরুল যথার্থই ধরেছেন। কারণ উপদেষ্টা পদে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এবং নির্বাচন করার চেষ্টা হলে সেটা হবে শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী। জনগণ সেটা মানবে না।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটি গঠন ছাড়াও এখন পর্যন্ত মোট ২১০টি উপজেলায় কমিটি করেছে। দল গঠনের সঙ্গে জড়িত নেতারা বলছেন তরুণদের পাশাপাশি নতুন এ রাজনৈতিক দলে যুক্ত হবেন সাবেক আমলা, রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করা হবে। আগামী ফেব্রæয়ারি মাসের মধ্যেই নতুন দল আত্মপ্রকাশ করবে এমন ঘোষণা দিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা সারাদেশ সফর করছেন, সম্ভাব্য নতুন দলের পক্ষে ক্যাম্পেইন-মতবিনিময় করছেন। শুধু তাই নয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে তিন সমন্বয়ক অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করছেন তারাও মাঝে মাঝে নতুন রাজনৈতিক দলের পক্ষে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। তারা সম্ভাব্য নতুন দলের হয়েই যেন কাজ করছেন। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো আশঙ্কা করছে ছাত্ররা ‘কিংস পার্টি’ তথা অন্তর্বর্তী সরকারে থেকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে নতুন দল গঠন করা হচ্ছে। কারণ ছাত্র সমন্বয়করা যে জেলায় সফরে যাচ্ছেন সেখানে প্রশাসনের লোকজন তাদের নানাভাবে সহায়তা করছেন। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর আশঙ্কা ঐক্যবদ্ধ ভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে হটানো হলেও কিছু ছাত্রনেতা ৫ আগস্টের আগের মানসিকতায় আর নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্পর্কে বাঘের যে দশা হয়’ এখন ‘ক্ষমতা’ নিয়ে সে দশাই হয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রনেতাদের। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদে বসে এবং বিভিন্ন পদপদবিতে বসে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নেয়ায় ছাত্রনেতাদের মাঘের অবস্থার মতোই ‘ক্ষমতার লোভ’ পেয়ে বসেছে। তারা এখন নতুন দল গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আর ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে ফলাফল কী হয় শেখ হাসিনা রেজিমে দেশের মানুষ দেখেছে। শুধু তাই নয়, নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নেয়া ছাত্রনেতাদের জামায়াতের মতোই বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের কথাবার্তাই বিষয়টি পরিষ্কার।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্মোহভাবে দেশসেবা করছেন এবং তিনি ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছেন। ড. ইউনূসের প্রতি দেশের ১৮ কোটি মানুষের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু এনজিও মার্কা কিছু উপদেষ্টা ও ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাদের নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে অতি আগ্রহ মানুষের মধ্যে সন্দেহের সষ্টি হচ্ছে এরাও হাসিনার মতোই সরকারে থেকে দলগঠন ও নির্বাচন করার দিতে যাচ্ছেন।
’৯০ এ পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচাপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ও পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন আইনে মন্ত্রী-এমপি ও উপদেষ্টারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বা তত্ত¡াবধায়ক সরকারের কোনো প্রতিনিধি যেহেতু ভোটে প্রার্থী হন না তাই এমন কিছুর নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তবে সংসদ রেখে যাতে ভোট করা যায় সে জন্য সুচতুন শেখ হাসিনা কৌশলের আশ্রয় নেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে (৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালের ভোট) তফসিল ঘোষণার পর একটি পরিপত্র জারি করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়; যেখানে নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা ও শর্তাবলী তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর ক্ষেত্রে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য হবে না’। অর্থাৎ ওই সব পদে থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ এ বলা হয়েছে, উপদেষ্টার পদে বসতে হলে ব্যক্তিকে ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না’- মর্মে সম্মতি দিতে হবে।
গত ১৮ ডিসেম্বর সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টা রাজনীতির সাথে জড়িত নন এবং তাই কেউ নির্বাচন করবে না। যদি কেউ নির্বাচন করতে চান, তবে তাদের উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করা ঠিক হবে না’।
তিনি আরো বলেন, যদি সবাই মনে করেন যে নতুন তত্ত¡াবধায়ক সরকার নির্বাচনের আয়োজন করবে বা নতুন কাউকে যুক্ত করা হবে, তবে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আইনে নির্ধারিত সময়সীমার সমাধান কিভাবে হবে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। তবে বর্তমান সরকার এখনও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না’।
রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার সব নাগরিকের রয়েছে। কিন্তু সরকারে থেকে দল গঠনের পৃষ্ঠপোষকতা ৫ আগস্টের চেতনার সঙ্গে যায় না। কয়েকদিন আগে শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। কেউ কেউ বলছেন, নতুন দলে সক্রিয় হওয়ার লক্ষ্যেই তিনি ওই পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ৫ আগস্টের চেতনা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। মানুষ নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে ভারতের পুতুল হাসিনাকে হটিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার এনেছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের যা খুশি করা করা সমীচীন নয়। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনার জন্য কয়েকদিন আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দেখা গেছে কোনো দলকে মোবাইল ম্যাসেজ পাঠিয়ে কোনো দলকে বৈঠকের দু’ঘন্টা আগে আমন্ত্রণ জানানো হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এতো হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করে দল গঠন করবেন, সরকারে থেকে নির্বাচন করবেন তাহলে শেখ হাসিনার অপরাধ কী? মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে সময় থাকতেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনা করা উচিত। পানি গড়ার আগেই সতর্ক সবার জন্যই মঙ্গলজনক। ঐক্যে ফাটল ধরলে হিন্দুত্ববাদী ভারত আরো হিংস্র হয়ে উঠবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।