১৫ই জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কার প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে চার কমিশন। এ ছাড়া আরও দুই কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব জমা দেয়ার কথা ছিল ৩১শে জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু এরইমধ্যে সরকার প্রধান ছয় কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে। উদ্দেশ্য- মৌলিক বিষয়গুলোতে আগে কমিশনগুলোর সমন্বয়। তারপর সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে সরকার। যার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকার যখন রাজনৈতিক ঐকমত্যের চেষ্টায় তখন এ ঐক্য আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ বিভিন্ন ইস্যুতে ইতিমধ্যে দলগুলো ও সরকারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি মনে করে, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার অনেকগুলোই জটিলতা বাড়াবে। অন্যদিকে, জামায়াত এসব সংস্কার প্রস্তাবনার পক্ষে অবস্থান নিলেও কিছু কিছু বিষয়ে তাদেরও দ্বিমত রয়েছে। বাকি দলগুলোও মনে করে এসব প্রস্তাবনার অধিকাংশই বাস্তবসম্মত নয়। তাই জাতীয় ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়া জটিল হবে। তবে সরকার চাইছে দলগুলোকে নিয়ে সংস্কার বাস্তবায়ন করা। কারণ এটি জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যেও বিষয়টি বারবার উঠে আসে।
এদিকে সরকারের চাওয়া অনুযায়ী সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশমালা সমন্বয়ে কাজ শুরু হয়েছে। যেসব বিষয়ে একাধিক কমিশনের সুপারিশ আছে, সেসব বিষয় চিহ্নিত করে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করবে কমিশনগুলো। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ছয় কমিশন প্রধানকে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। যেখানে সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ। এ কমিশন সংস্কার কমিশনগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করে সংস্কার কাজে হাত দেবে। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, এটি রিপোর্ট পেলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও পাওয়া যেতে পারে। সরকারের চাওয়া অনুযায়ী, সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনার আগেই অংশীজনদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। যেটি সরকার ও রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
গত সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যালয়ে মতবিনিময় করেন কমিশন প্রধানরা। বৈঠক শেষে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ইতিমধ্যে যে কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেসব কমিশনের সুপারিশমালা পর্যালোচনা এবং সমন্বয়ের জন্য কমিশন প্রধানদের মতবিনিময় সভা হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রফেসর আলী রীয়াজ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধানের পক্ষে বিচারপতি এমদাদুল হক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। কমিশন প্রধানরা নিজ নিজ কমিশনের দেয়া সুপারিশগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং এগুলোর ভেতরে ভিন্ন মত থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। কমিশন প্রধানরা আশু ও দীর্ঘমেয়াদে সংস্কারের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করার বিষয়ে একমত হন।
গতকাল বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেখানে দলটি মনে করে, কমিশনগুলোর অনেক প্রস্তাব জটিলতা বাড়াবে। চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার ভাবনা এবং সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাব অপ্রয়োজনীয়। এতে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগকেও অপ্রাসঙ্গিক মনে করছেন দলটির নেতারা। বলেন, ৫ই আগস্টের পর পরই যদি এ ধরনের কোনো ঘোষণা আসতো তাহলে তখন এ বিষয়ে একটা রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি হতে পারতো। জানা গেছে, বৈঠকে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে শিগগির সংলাপের আশা করছে বিএনপি। স্থায়ী কমিটির নেতারা বলেন, রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব জাতির সামনে দিয়েছে। এরপরও বিএনপি সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনকে সহযোগিতা করতে চায়। এজন্য ছয়টি সংস্কার কমিটিও গঠন করেছে দলটি। কী কী সংস্কার করা যেতে পারে- এ ব্যাপারে কমিশনের কাছে প্রস্তাব জমাও দিয়েছে তারা। বৈঠকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনা হয়।
এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না মানবজমিনকে বলেন, আমার মনে হয় না এটি বাস্তবায়ন হবে। জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হবে না। সরকার যদি উদ্যোগ নিয়ে ভালো কিছু আগে থেকেই করতো তাহলে সেটা বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল। তারা বলছে, কোনো কিছু চাপিয়ে দেবেন না। এই সরকারের পাঁচ মাস হয়ে গেল, এখনো ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়নি। এই রিপোর্টের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য হবে বলে মনে করি না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, তারা একটা প্রস্তাবনা জমা দিয়েছেন। এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা প্রয়োজন। আমাদেরও কিছু প্রস্তাবনা ছিল। ডান, বাম বিভিন্ন ধরনের দল আছে- সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যে আসা কঠিন। আমার মনে হয়, মিনিমাম কিছু বিষয়ে একমত হয়ে বাকি বিষয়গুলো গণপরিষদে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার এক অনুষ্ঠানে বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে আসা যাবে সেসব বিষয়ে সংস্কার করা হবে। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমরা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে প্রস্তাবনা দিয়েছি সেগুলো নিয়ে জটিলতার কোনো কারণ দেখছি না। অন্য কমিশনের বিষয় বলতে পারবো না। আমরা দলগুলোর নিবন্ধন, ভোটাধিকার, সীমানা, নির্বাচনী আচরণবিধি, অপরাধ, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করেছি। যেগুলো নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে দেখছি না।