সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক পাপ্পু শেখ। আটাশ বছর বয়সী এই যুবক পরিবার নিয়ে থাকতেন রাজধানীর জুরাইন এলাকায়। সোমবার সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হওয়ার ১০ মিনিট পরেই তাকে জুরাইন কনকর্ড স্কুলের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় আরেকজন আহত হন। পাপ্পুর পরিবার জানিয়েছে, ওই এলাকার কানা জব্বারের ছেলে বাপ্পা ও স্থানীয় কানচিসহ কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী পাপ্পুকে গুলি করে পালিয়ে গেছে। এর কিছুদিন আগে বাপ্পার ভাতিজা হিমেলের সঙ্গে পাপ্পুর ঝগড়া হয়েছিল। সেই ঘটনার জের ধরে পাপ্পুকে গুলি করে হত্যা করতে পারে বলেও ধারণা করছে নিহতের পরিবার। এ ঘটনায় র্যাব-১০ হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
এর আগে রোববার একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে খুলনা মহানগর এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে হাসিব হাওলাদার (৪০) ও ফজলে রাব্বি রাজন (৩৫) আদালত পাড়ায় মোটরসাইকেলের ওপর বসে গল্প করছিলেন। তারা দুজনই শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাশ গ্রুপের সহযোগী। গল্প করা অবস্থায় প্রকাশ্যে ভরদুপুরে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। শুধু গুলি করেই তারা থামেনি, যাওয়ার সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুনিরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ সময় আশপাশের মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি হয়, শুরু হয় ছোটাছুটি। নিহতরা হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে নগরীর অপর সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর সম্পৃক্ততা রয়েছে। শুধু জুরাইন এবং খুলনার আদালতপাড়ায় নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশেই প্রকাশ্য গুলি করে হত্যার ঘটনা বেড়েছে। সন্ত্রাসীরা এখন বেপরোয়া। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, পূর্বশত্রুতা, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা কারণে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করছে। এসব ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি যেমন সামনে আসছে ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে আদালত প্রাঙ্গণের মতো নিরাপদ এলাকায়ও গুলি করে হত্যার ঘটনা শঙ্কা তৈরি করেছে। ঢাকার আদালতপাড়ায়ও গত মাসে এক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি বেশি থাকে তখন প্রকাশ্য গুলি করে হত্যার ঘটনা বেড়ে যায়। বিশেষ করে গত বছরের ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পুলিশি দুর্বলতার কারণে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যায়। ওই সময় দেশের বিভিন্ন থানায় দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে লুটপাট করে পুলিশের অস্ত্র নিয়ে যায়। এ ছাড়া গণভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসএসএফ সদস্যদের অস্ত্র লুট হয়। এসব অস্ত্রের বড় একটি অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের থানা ও কারাগার থেকে পাঁচ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে চার হাজার ৪০৮টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার হয়নি ১ হাজারের বেশি অস্ত্র। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এসএমজি, অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল ও এলএমজির মতো মারণাস্ত্র রয়েছে। শুধু অস্ত্র নয় ওই সময় অস্ত্রের সঙ্গে গোলাবারুদও লুট হয়েছিল। সেগুলো পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। এসব অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ। একদিকে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। অন্যদিকে এসব অস্ত্র হাত বদল হয়ে চলে গেছে সন্ত্রাসী, চরমপন্থি, উগ্রবাদী, জঙ্গি, জেল পলাতক সন্ত্রাসীদের কাছে। তাই গোয়েন্দারাও এসব অস্ত্রের হদিস পাচ্ছেন না। এতে করে শঙ্কা রয়ে যায় কোথায় কখন এসব অস্ত্র ব্যবহার হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, দেশের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দুই দেশ থেকে অস্ত্র ঢুকছে। সীমান্তের অন্তত ১৮ থেকে ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করে। অস্ত্র চোরাচালানকারীরা একই রুট ব্যবহার করে দীর্ঘদিন অস্ত্রের চালান নিয়ে আসে না। কারণ ওই রুটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বেড়ে যায়। তাই তারা সুযোগ সুবিধামতো রুট পরিবর্তন করে।
গত ১১ই নভেম্বর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারেক সাইদ মামুনকে। আদালতপাড়ায় মামুনকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ১৫ই নভেম্বর লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। রাজধানীর পল্লবীতে এক যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৭ই নভেম্বর পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানার সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে। আগের মাসে চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিন-দুপুরে বিএনপি সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নিহত এই ব্যক্তি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ও রাউজানের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম মাফিয়া ইমন ব্যাংককে ঢাকার মাফিয়া ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ডেরায় বসে ঢাকার অপরাধ জগতের কলকাঠি নাড়ছেন। মোহাম্মদপুরের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ আন্ডারওয়ার্ল্ডে সরব তৎপরতা চালাচ্ছেন। মালয়েশিয়া থেকে রাজধানীর ধানমণ্ডি, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও হাজারীবাগ এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনা করছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন। মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন পিচ্চি হেলাল। ইতিমধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ইমন, পিচ্চি হেলাল এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও জিডি হয়েছে। গত বছর ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ইমন ও পিচ্চি হেলাল বাহিনীর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলছে। একপর্যায়ে পিচ্চি হেলাল দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় মোহাম্মদপুরের নিয়ন্ত্রণও চলে গেছে ইমনের হাতে। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তারের পর মামুন ওইসব এলাকার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন। ওদিকে ক্লাবপাড়া, মতিঝিল, খিলগাঁওসহ বেশ কয়েকটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান গ্রুপের সদস্যরা।
অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, একই ধরনের অপরাধ যখন ক্রমাগত হতে থাকে তখন বুঝতে হবে যারা দায়িত্বে আছেন তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। আর যতটুকু পারছেন ততটুকুকে অপরাধীরা ভয় পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে সতর্কতাও বাড়ছে না আর অপরাধ থেকে দূরে থাকার মতো মনোভাব তৈরি হচ্ছে না। তিনি বলেন, তিনটা কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে। থানা থেকে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। নির্দেশনা অনুযায়ী বাতিল করা লাইসেন্সধারী অস্ত্র থানায় জমা না দেয়া ও সীমান্ত দিয়ে অবাধে অবৈধ অস্ত্র দেশে প্রবেশ করছে। এতে করে সন্ত্রাসীদের হাতে এখন অনেক অবৈধ অস্ত্র মজুত আছে। দ্বিতীয়ত গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশের কারাগার ভেঙে যেসব দাগী সন্ত্রাসী পালিয়েছেন এবং জামিনে যেসব সন্ত্রাসী মুক্তি পেয়েছেন তাদের বিষয়ে পুলিশ নজরদারি করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই নজরদারি হচ্ছে না। আর তৃতীয়ত প্রকাশ্য এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেগুলো জোরালো হচ্ছে না। পুলিশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে গিয়ে চিন্তা করে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কোনটা। এ ছাড়া সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও প্রভাবশালী হলেও ব্যবস্থা নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব করে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এটা জাতীয় ও রাজনৈতিক একটা সমস্যা। শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে নির্মূল করা সম্ভব না। কারণ এই সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক কোনো কমিটমেন্ট নাই। সন্ত্রাসীদের নিভৃত করা, দমন করার সিদ্ধান্ত সেখান থেকেই আসতে হবে। তা না হলে একেক সময় একেক সন্ত্রাসী আসবে।