সত্তরোর্ধ্ব স্বামীকে নিয়ে নিজের বাসায় বসবাস করছিলেন ক্যান্সারে আক্রান্ত আম্বিয়া খাতুন (৫৮)। ওই অবস্থায় ঘর থেকে তাকে টেনেহিঁচড়ে তাড়িয়ে তালা লাগিয়ে দেন তারই দুই ভাই।
এ সময় ঘরে থাকা তার ওষুধ-চিকিৎসার কাগজগুলোর জন্য ভাইদের হাতে-পায়ে ধরলেও তা নিতে দেননি। এদিকে তালাবদ্ধঘরে চিকিৎসার সমস্ত কাগজপাতি থাকায় গত ৪ মাস ধরে চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে তার। এতে দিনদিন অসুস্থতা বাড়ছে ওই নারীর।
এদিকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও রিপোর্ট ছাড়া মায়ের চিকিৎসা করাতে না পেরে মালয়েশিয়া প্রবাসী বৃদ্ধার ছোট ছেলে শেখ তারিকুল হাসান মিলন হোয়াটস্যাপ কল করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাই আমার আম্মারে বাঁচান, জায়গা গেলে জায়গা পাব। আম্মা চলে গেলে আর পাব না। আম্মার চিকিৎসার কাগজগুলো নিয়ে দেন ভাই।’ অপরদিকে স্ত্রীর জমি জোরপূর্বক দখল করায় থানায় লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগীর স্বামী সত্তরোর্ধ্ব শেখ আবুল হাসেম।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারোবাড়ি ইউনিয়নের গলকুন্ডা এলাকায় পৈত্রিক সূত্রে সাড়ে ৫ শতক জমি পান আম্বিয়া খাতুন। এরপর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে নিজের নামে সেটা নামজারি করান তিনি। খারিজের পর নিজের মেয়েকে সেখান থেকে ৩ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে লিখে দেন। বাকি আড়াই শতকের সামনের অংশে দোকানঘর এবং পেছনের অংশে থাকার ঘর নির্মাণ করেন। দোকান ঘরটি ভাড়া দিয়ে ওই বাসাতেই ৬ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী মিলে বসবাস করেছিলেন। ওই অবস্থায় ২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আম্বিয়া খাতুনের দুই ভাই নুরুল আলম দুলাল (৬০) ও মো. সাইফুল আলম জোসনা মিয়াসহ তাদের লোকজন নিয়ে আম্বিয়া খাতুনকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে দিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে দেয়।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল (২২ জানুয়ারি) বুধবার বিকেলে ভুক্তভোগী আম্বিয়া খাতুনের স্বামীর বাড়ি একই ইউনিয়নের ইটাউলিয়া গ্রামে যান প্রতিনিধি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন আম্বিয়া খাতুন। এ প্রসঙ্গ তুলতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন তিনি।
কান্না করতে করতে আম্বিয়া খাতুন বলেন, ‘আমি আমার ভাইডিরে আতো-পায়ো (হাত-পা) ধইরা কইছি ভাইরে তোরা আমারে মরণের লাইগ্যা দিস না। ঘরের ভিত্তে (ভেতরে) আমার ওষুধপাতি, চিকিৎসার কাগজপাতি এইডি আমারে দে।' এই সময় আমার ছুডু ভাইডা (দুলাল) কয়তাছে এনতে যাগা, কোনো কাগজপাতি নাই। আর তুই মইরা যা। তুই মরলে আমরার কী?’
আম্বিয়া খাতুন আরও বলেন, ‘আমি মরি-বাঁচি, আমার জমিডা আমারে ফিরত লইয়া দেওহাইন।’
এক সময় কথা হয় আম্বিয়া খাতুনের মেয়ে হাছিনা ওরফে হ্যাপির সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হ্যাপি বলেন, ‘২০২৩ সালে আম্মার ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপরে আমরা চিকিৎসা করাতে থাকলে আম্মা হাঁটা-চলাসহ টুকটাক কাজ করতে পারতো। কিন্তু যখন থেকে আম্মার ওষুধ খাওয়া বন্ধ হলো তখন থেকেই আম্মা বিছানায় পড়ে গেছে। ওঠেও দাঁড়াতেও পারে না। আম্মার এই অবস্থার জন্য আমার মামারা দায়ী। আমি এদের বিচার চাই।’
এসব অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে অভিযুক্ত নুরুল আলম দুলাল বলেন, ‘ওই জমিটা আমার ছোট ভাই সাইফুল আলম ওরফে জোসনা মিয়ার। সে ওই জমিতে ঘর এবং দোকানঘর নির্মাণ করেন। এরপর আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাব খাটিয়ে আম্বিয়া খাতুনের ছেলে সেটা দখল করে তার মায়ের নামে খারিজ করে। এরপর ৫ তারিখের পর সাইফুল ফের সেটা দখলে নেয়। আর ঘরে থাকা সমস্ত জিনিসপাতি পুলিশের উপস্থিতিতে আমার ভগ্নিপতি এবং ভাগনে বউকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আর ওষুধ এবং চিকিৎসার কাগজপাতি ওই ঘরে ছিল কিনা তাও আমার জানা নাই। কিংবা পরেও পাওয়া যায়নি।’
এদিকে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় অভিযোগ দিলে সেটা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় আঠারোবাড়ি (রায়ের বাজার) পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শককে। এ প্রসঙ্গে তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। তদন্ত করে জানা যায় ওই জমিটা নিয়ে আদালতে দেওয়ানি মামলা চলমান। যে কারণে পুলিশের কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। তবে এটাকে কেন্দ্রকরে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে আমরা তৎপর আছি। তাছাড়া ওই ঘরে যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর চিকিৎসার কাগজপাতি থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই সেগুলো দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’