Image description

পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দলগতভাবে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা পেয়েছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। তারা বলছে, এ ঘটনার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল। এ ছাড়া এই ঘটনায় ভারতেরও সম্পৃক্ততা পেয়েছে কমিশন।

 

ঢাকার পিলখানায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ—বিজিবি) সদর দপ্তরে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ১১ মাস ধরে তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করে এই কমিশন।

বিজ্ঞাপন
 

তদন্ত কমিশন রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

পিলখানার প্রকৃত ঘটে উঠে এসেছে কমিশনকে দেওয়া সাক্ষীদের জবানবন্দিতে। ৮৫ নম্বর সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেছেন—তথ্য আসে যে শেখ ফজলে নূর তাপস ফোনে নির্দেশ দিয়েছিলেন একটি ছেলেকে মিছিল সংগঠিত করে বিডিআরে প্রবেশ করাতে। ফোন কলটি ডিজিএফআই রেকর্ড করেছিল। পরবর্তীতে হাজারিবাগের একটি বাসা থেকে ছেলেটিকে ধরা হয়। বয়স আনুমানিক ২১-২২ বছর, পাতলা গড়নের, নাম সম্ভবত জুয়েল। মেজর মনির তাকে ধরেন। লে. কর্নেল মোয়াজ্জেম নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টিএফআইতে নিতে, কিন্তু লে. কর্নেল সালেহ নির্দেশে মেজর মনির তাকে র‍্যাবের কাছে হস্তান্তর করেন।

এই সাক্ষী কমিশনকে আরো জানায়—প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ছেলেটি স্বীকার করে যে তাপসের নির্দেশেই সে মিছিল নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল। প্রথমে তার সঙ্গে বেশি লোক না থাকলেও বের হওয়ার সময় অনেক লোক ছিল। জুয়েল জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছিল যে মিছিলে যুবলীগের লোকজন অংশ নিয়েছিল। এ তথ্য মেজর মনির লে. কর্নেল সালেহকে জানায়। পরে কর্নেল আলমাস রাইসুল গনি একটি ওভারঅল রিপোর্ট তৈরি করেন যেখানে ফ্যাক্ট, ইনসিডেন্ট ও ফাইন্ডিংস আকারে সবকিছু উল্লেখ করা হয়। সেই লেখাটি সরকারের পক্ষে ছিল না এবং মেজর মনির মনে করেন যে এ রিপোর্ট দেওয়ার পর কর্নেল আলমাস রাইসুল গনির অবস্থান দুর্বল হয়ে যায়।

 

জবানবন্দিতে আরো উঠে এসেছে—২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল হাকিম আজিজ ও মেজর মনির এপিসি নিয়ে ভিতরে ঢোকেন। গেইট থেকে প্রায় দুইশত গজ ভিতরে যাওয়ার পর তারা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিককে দেখেন। মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিক এপিসি নিয়ে ভিতরে ঢোকার কারণে প্রচণ্ড ক্ষোভে ব্রিগেডিয়ার হাকিমকে গালিগালাজ করেন।

কমিশনকে দেওয়া চার নম্বর সাক্ষী বলেছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার ডিটাচমেন্ট কমান্ডার কর্নেল আলমাস রাইসুল গনি নিজ উদ্যোগে কিছু রিপোর্ট তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন এবং কিছু কাজও তিনি করেছিলেন। তার এই উদ্যোগের কারণেই তাকে তার কাজ শুরুর তিন-চারদিন পরেই পোস্টিং আউট করে দেয়া হয় এ বিষয়ে লে. জেনা. মোল্লা ফজলে আকবর কোনো কিছু স্মরণ করতে পারেননি। তবে তিনি মনে করতে পারেন যে নতুন সরকার আসার পর অনেককেই ডিজিএফআই থেকে বদলি করা হয়েছিল।

 

তার জবানবন্দিতে আরো উঠে এসেছে—পাঁচজন ক্যাপ্টেন/মেজর পদবির অফিসারকে ব্যারিস্টার তাপস হত্যা চেষ্টা মামলায় জড়ানোর বিষয়ে ডিজিএফআই এর কোনো ইন্ধন ছিল বলে লে. জেনা. মোল্লা ফজলে আকবর মনে করেন না।

তদন্ত কমিশনকে দেওয়া ৮ নম্বর সাক্ষী বিশ্বাস করেন—কেবল ওয়েলফেয়ার বা ডাল-ভাত কর্মসূচির কারণে বিদ্রোহ হয়নি, হয়তোবা বাইরের উসকানি ছিল। বিডিআর সদস্যদের আত্মবিশ্বাস, লিফলেটের ভাষা, রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় যাওয়া এ সমস্ত ঘটনা উস্কানির প্রমাণ। ৪৬ ব্রিগেড প্রস্তুত ছিল, ট্যাংক এসেছিল, গান প্রস্তুত ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়। যমুনার বৈঠকেই রাজনৈতিক সমাধান নির্ধারণ হয়েছিল।

১৭ নম্বর সাক্ষীর ভাষায়—২৫ বা ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ডিজি ডিজিএফআই এর সঙ্গে পিলখানার কাছে এসেছিলেন এবং তার সঙ্গেই ফেরত যান। ২৬ ফেব্রুয়ারি ট্যাংকের সঙ্গে আবার আবাহনী মাঠের কাছে আসেন। তিনি আম্বালা রেস্টুরেন্টেও কখনো ঢোকেননি এবং ব্রি. জেনা. মামুন খালেদের সাথেও তার দেখা হয়নি। তার দায়িত্ব ছিল ট্যাংকের সাথে থেকে অবজার্ভ করা।

তার ভাষ্যমতে—শুরুতেই ব্যবস্থা নিলে ফল ভিন্ন হতে পারত। তিনি ডিজিকে কয়েকবার বলেছিলেন তাকে ট্যাংকসহ এগোতে দিতে। কিন্তু বারবার ডিজি ডিজিএফআই তাকে থামিয়েছেন। মেজর জেনারেল ইমরুল কায়েস বিশ্বাস করেন যে ট্যাংক ব্যবহার না করা একটি মারাত্মক ভুল ছিল।

চার নম্বর সাক্ষীর ভাষায়—র‍্যাব বিডিআরের কিছু পলায়নপর সদস্যকে ধরে একটা বাসে এ করে আবাহনী মাঠে নিয়ে আসে। এর কিছুক্ষণ পরেই ডিজি ডিজিএফআই সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে ছেড়ে দিতে বলেন বলে যে অভিযোগ আছে তা ডিজি ডিজিএফআই সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন।

১০১ নম্বর সাক্ষীর ভাষ্য মতে, আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৬টা ৩০ মিনিট এর দিকে র‍্যাবের ক্যাপ্টেন আশিক একটি পিক আপে করে ৯/১০ জন পলায়নরত বিডিআর সদস্যকে আবাহনী মাঠে ধরে নিয়ে আসেন যারা হাজারীবাগ সীমানা দেয়াল টপকে পালাচ্ছিল। সেখানে উপস্থিত— ডিজিএফআই এর ডিজি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ক্যাপ্টেন আশিককে প্রশ্ন করেন কার আদেশে ক্যাপ্টেন আশিক পলায়নরত বিডিআর সদস্যদের ধরে এনেছেন। সাথে সাথেই র‍্যাব তাদেরকে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করে।

১৪ নম্বর সাক্ষীর মতে—বিডিআর বিদ্রোহ দমনের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল এর বৈঠক আহ্বান না করা একটি মৌলিক ভুল ছিল।কাউন্সিল আহ্বান করলে সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করার বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপিত হত বলে তিনি মনে করেন। তার মতে আর একটি মৌলিক ভুল ছিল বিডিআর বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে বিদ্রোহীরা পিলখানার অভ্যন্তরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর উৎসাহ, সময় এবং সুযোগ পেয়ে যায়। এরপর রাজনৈতিক ভাবে সমাধানের নামে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে বিদ্রোহটি পুরোপুরি হত্যাযজ্ঞে রূপ নেয়।