Image description

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ৭০ শতাংশ মানুষ। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণে বাসিন্দাদের ৬৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৭৮ শতাংশ নারী নিরক্ষর। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে শৌচাগারের অভাব রয়েছে। রয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব; যে কারণে স্থানীয়দের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে অসন্তোষ।

সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপের জন্য প্রস্তাবিত মাস্টারপ্ল্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপকে রক্ষায় অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত করা খসড়া মাস্টারপ্ল্যান সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।

গত সোমবার (২৪ নভেম্বর) এ পরিকল্পনাটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পোর্টালের নোটিশ বোর্ডে উন্মুক্ত করা হয়েছে। আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের মতামত দিতে বলা হয়েছে।

মাস্টারপ্ল্যানে সেন্টমার্টিনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলা হয়েছে, দ্বীপটিতে এক হাজার ৪৪৫টি পরিবারের বসবাস। দ্বীপটির মোট জনসংখ্যা ৯ হাজার ৮৮৫ জন। প্রতি পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ৬ দশমিক ৮৪ জন, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি। দ্বীপের জনসংখ্যা কাঠামো তারুণ্য-প্রধান। মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং প্রায় ৪৪ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে।

মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি হলে এ জনমিতিক কাঠামো সম্ভাব্য জনমিতিক লভ্যাংশে রূপান্তরিত হতে পারে।

দ্বীপের সামগ্রিক অর্থনীতি প্রধানত মৎস্য আহরণ মোট আয়ের মোট আয়ের ৬১ শতাংশ এবং পর্যটন মোট আয়ের ৩১ শতাংশ। স্থানীয় পরিবারগুলোর মাসিক গড় আয় মাত্র ৬ হাজার ৪৪৮ টাকা, যা জাতীয় মাসিক গড় আয়ের তুলনায় কম। তাদের এই আয়ের সঙ্গে, বিশেষত মাছ আহরণ ও পর্যটন নির্ভর অর্থনৈতিক কার্যক্রম মৌসুমি চক্রে জড়িয়ে রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ড. ফাহমিদা খানম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “সেন্টমার্টিনে অনেক বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যদিও প্রবাল দ্বীপ না, তবে প্রবাল রয়েছে। আয় করতে হলেও হলেও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে, প্রবালগুলো বাঁচাতে হবে। পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। পরিবেশটা যদি ব্যবস্থাপনা করতে পারি তাহলে আয়ও হবে, জীববৈচিত্র্য বাঁচবে।”

পর্যটক বাড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কতটুক আমরা রিভাইস করতে পারবো তার ওপর নির্ভর করছে। শুধু পর্যটক বাড়ালে তো হবে না, জীববৈচিত্র্য না থাকলে তো আয় থাকবেই না। উন্নয়ন হবে না তা বলছি না। লোকজনের যাতে আয় বজায় থাকে সেদিকটাও আমরা দেখছি। সেভাবেই প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে।”

শিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে শিক্ষার সুযোগ সীমিত। শিক্ষাব্যবস্থায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়/কলেজ, একটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৭টি মাদ্রাসা রয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানে তুলে ধরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাদ্রাসা বেশি। তাছাড়া মোট ৯ হাজার ৮৮৫ জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শিক্ষার হার নিম্নমুখী।

মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রধানত টেকনাফ থেকে ফেরি পরিষেবার মাধ্যমে পরিচালিত। মৌসুমি দুর্যোগ এবং বর্ষাকালে এই যোগাযোগ অনিশ্চিত। দ্বীপের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ প্রধানত পায়ে হেঁটে, রিকশাভ্যান এবং ভাড়া সাইকেলের ওপর নির্ভরশীল। দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

সেন্টমার্টিনে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার সুযোগ নেই। ফলে ঝুঁকিপূর্ণভাবে দেশের মূল ভূখণ্ডে যেতে হয় তাদের। এই পরিস্থিতি শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং নারী শিক্ষার্থীদের ওপর অসামঞ্জস্য প্রভাব বিস্তার করে। যা প্রাথমিক শিক্ষার পর তাদের পড়াশোনা ব্যাহত করে।

স্বাস্থ্যসেবা

স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রেও অবকাঠামো ও জনবল ঘাটতি সুস্পষ্ট। দ্বীপে একটি হাসপাতাল থাকলেও তা জনবল ও সেবার মানদণ্ডে সীমিত। ফলে অধিকাংশ মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য স্থানীয় ফার্মেসির ওপর এবং জটিল স্বাস্থ্যসেবার জন্য দূরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে বিশেষত গর্ভবতী নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি তীব্রতর রূপে প্রতিফলিত হচ্ছে।

বাসস্থানের ক্ষেত্রে কাঁচা ৬৮ শতাংশ, ঝুপড়ি ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ, সেমি-পাকা ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পাকা ঘর শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় ডিজেল জেনারেটর থেকে সৌর গ্রিডে পরিবর্তিত হয়েছে, যা ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, তবে খরচ অনেক বেশি।

কর্মসংস্থানের অভাবে অসন্তোষ বাড়ছে সেন্টমার্টিনে

স্যানিট্রেশন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সেন্টমার্টিনে। এখানে ৩০ শতাংশ ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ফ্লাশ টয়লেট ব্যবহার করে, ১৮ শতাংশ পিট ল্যাট্রিন, ১১ শতাংশ ওয়াটার শিল্ড ট্যাংক ব্যবহার করে আর ৩৫ শতাংশ জনগোগষ্ঠীর কোনও স্যানিট্রেশন সুবিধা নেই। নেই কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা।

মাস্টারপ্ল্যানে আরও উল্লেখ করা হয়, দ্বীপে পর্যাপ্ত চিকিৎসাকর্মীসহ একটি সুসজ্জিত হাসপাতালে অভাব রয়েছে। যা ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বাধা সৃষ্টি করছে। সীমিত সুবিধা এবং প্রবেশাধিকারের অভাবে গর্ভবতী নারী এবং গুরুতর আহ্ত রোগীরা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য

দ্বীপে পর্যটন কার্যক্রম দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে হোটেল ও রিসোর্ট সংখ্যা ১৯০টিরও বেশি। কিন্তু এদের অর্ধেকের মালিক অ-স্থানীয় ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার প্রসার সীমিত হয়ে আছে। কর্মসংস্থানের কিছু সুযোগ তৈরি হলেও স্থাণীয় জনগণ প্রত্যাশিত মাত্রায় সুফল অর্জন না করতে পারায় সামাজিক অসন্তোষ প্রবণতা বাড়ছে।

মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, দ্বীপটির অধিকাংশ বাসিন্দা পর্যটন ও সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। মৌসুমি কর্মসূংস্থান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। পর্যটন সুবিধা বহিরাগত মালিকানাধীন হওয়ায় স্থানীয়রা অর্থনৈতিকভাবে তেমন লাভবান হয় না। প্রায় ৭০ শতাংশ বাসিন্দা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন এবং বেকারত্ব ও বিকল্প জীবিকার অভাব দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী দ্বীপের সম্পদ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তবে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তাদের টেকসই বিকল্প আয়ের সুযোগ প্রয়োজন বলে মাস্টারপ্ল্যানে উল্লেখ করা হয়।

বিকল্প আয়ের জন্য ক্ষুদ্রঋণ সেবা

মাস্টারপ্ল্যানে বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ক্ষদ্রঋণ সেবা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অংশগ্রহণমুলক ইকোসিস্টেম ব্যবস্থাপনা, যেখানে বিভিন্ন জোনভিত্তিক এলাকায় ন্যায্যতাভিত্তিক সুবিধা ভাগাভাগি নিশ্চিত করা হবে। সীমিত মাত্রায় মৎস আহরণের মাধ্যমে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করা হবে।

সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন ৫০০-৯০০ জন পর্যটক যেতে পারবেন

আগামী জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন দুই হাজার পর্যটক যেতে পারবেন বলে জানিয়েছে সরকার। তবে মাস্টারপ্ল্যানে তা আরও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন হলে সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন ৫০০-৯০০ জন পর্যটক যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হবে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, বর্তমানে পিক সিজনে প্রতিদিন তিন হাজার থেকে সাত হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। দৈনিক রাত্রিযাপনের সুবিধা রয়েছে চার হাজার ১৫৫ জনের। বিপরীতে রাত্রিযাপন করেন ধারণক্ষমতার প্রায় প্রায় দ্বিগুণ পর্যটক। দ্বীপে প্রায় ১০৯টি প্রতিষ্ঠান পর্যটকদের আবাসন সুবিধা প্রদান করে। রিসোর্টের এই অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণ আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এবং পরিবেশ দূষণ বাড়িয়েছে। কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অপর্যাপ্ততা এই সমস্যাগুলোকে আরও গুরুতর করে তুলেছে, ফলে পর্যটন সুবিধার মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

কর্মসংস্থানের অভাবে অসন্তোষ বাড়ছে সেন্টমার্টিনে

সংরক্ষণ ও পর্যটন নির্দেশিকা

সেন্টমার্টিন দ্বীপের সংরক্ষণ ও পর্যটন নির্দেশিকায় যেসব বিষয় বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- অবকাঠামো নির্মাণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশের ক্ষতি করে এমন নতুন নির্মাণ নিষিদ্ধ করা, দ্বীপরে ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাধ্যতামূলক অনলাইন নিবন্ধন ও প্রবেশ ফি চালু করা, বর্জ্য ফেলা, শব্দদূষণ এবং সামুদ্রিক জীব সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, দ্বীপে মোটরচালিত যানবাহন নিষিধ্ধ করা, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট রাস্তায় রিকশা ও বাইসাইকেল চালানোর অনুমতি দেওয়া এবং সামুদ্রিক আবাস-চরিত্র রক্ষার জন্য পর্যযটকবাহী হাজাজের গতি নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দিষ্ট দূরত্বে নোঙর করার নিয়ম চালু করা।

সামুদ্রিক সুরক্ষিত জোন ঘোষণা

সরকার সেন্টমার্টিনের চারপাশে এক হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক জোন হিসেবে ঘোষণা করেছে। যা মোট অঞ্চলের প্রায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে ২০২৩টি বেশি প্রজাতির মাছকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এটি বিশ্বব্যাপী হুমকির সম্মুখীন সামুদ্রিক প্রজাতি যেমন ইন্দো-প্যাসিফিক হাম্পাক ডলফিন, হোয়েল শার্ক এবং বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপকেও সুরক্ষা দিয়েছে।

২০২৩ সালের পরিবেশ বান্ধব পর্যটন নির্দেশিকার বিধিনিষেধের পরিবর্তে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলকভাবে এবং প্রয়োগযোগ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে এই মাস্টার প্লানে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

বিনিয়োগ প্রকল্প

মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পর্যযটন গন্তব্য। এখানে ম্যানগ্রোভ বন, প্রবাল প্রাচীর এবং শৈবালের মতো বহুধা জীববৈচিত্র্যের আবাস। দ্বীপের প্রতিবেশ ব্যবস্থা উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ক্রমবর্ধমান পর্যটন ও জনসংক্যার কারণে তা মারাত্মক চাপে রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিবেশ অধিদফতর ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রতিবেশভিত্তিক উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

১০ বছর মেয়াদে মাস্টারপ্ল্যান, উন্নয়নে ২৬ প্রকল্প

বাস্তুতন্ত্র ও প্রজাতি সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে দশ বছর মেয়াদে একটি কৌশলগত কাঠামোর ভেতরে প্রণয়ন করা হয়। সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যানে ৯টি উন্নয়নমূলক খাতে ২৬টি লক্ষভিত্তিক প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনার চারটি প্রকল্প, মৎস সম্পদ ও বেনথিক জীববৈচিত্র সংরক্ষণে দুটি প্রকল্প, প্রবাল সম্পদ এবং প্রবাল-নির্ভর উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণে দুটি প্রকল্প, কচ্ছপ ও তাদের বসবাস ও ডিম পাড়ানোর জন্য স্থান সংরক্ষণে দুটি প্রকল্প, স্থলভিত্তিক উদ্ভদ ও প্রাণী সংরক্ষণ ও উন্নয়নে ৬টি প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্যোগের দুটি প্রকল্প, ভূগর্ভস্থ জলের সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য দুটি প্রকল্প, অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে দুটি প্রকল্প এবং জীবন-জীবিকা উন্নয়নের জন্য তিনটি প্রকল্প। এই সব প্রকল্পের জন্য আনুমানিক মোট ব্যয় ৫৪৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন টাকা।

মাস্টারপ্ল্যানে সাজানো হয়েছে স্বল্প (১-৩ বছর), মধ্য মেয়াদি (১-৫ বছর) এবং দীর্ঘ মেয়াদি (১-১০ বছর)।

কর্মসংস্থানের অভাবে অসন্তোষ বাড়ছে সেন্টমার্টিনে

সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান

সেন্টমার্টিন দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। স্থানীয়ভাবে নারিকেল জিঞ্জিরা না পরিচিত। এটি টেকফনাফ পেনিনসুলার দক্ষিণে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে এবং মিয়ানমার উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত। দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায়। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। সামুদ্রিক সীমানার কৌশলগত নৈকট্যের কারণে দ্বীপের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা  এবং উপকূলীয় নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনায় জেলা প্রশাসন এবং জাতীয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকে।

প্রবাল প্রাচীর ও সামুদ্রিক সম্পদের অবক্ষয়

প্রবাল অধ্যুষিত দ্বীপটিতে অতিরিক্ত সংখ্যায় পর্যটকের চলাফেরা, তাদের ঘিরে স্যুভেনির বাণিজ্য, অতিরিক্ত প্রবাল উত্তোলন, পয়োনিষ্কাশন ও রাসায়নিক দূষণ, বিদেশি মাছ ধরার ট্রলার, জমাট পলি, পরিত্যক্ত মাছ ধরার জাল, নৌকা নোঙর করা, ভাঙন, অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, অবৈধভাবে প্রবাল সংগ্রহ এবং প্রবাল প্রাচীরের ওপর দিয়ে হাঁটার কারণে সৃষ্ট ভৌত ক্ষতির মতো মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দ্বীপের প্রবাল প্রাচীরগুলো। প্রবাল ব্লিচিং (সাদা হয়ে যাওয়া) এবং হোয়াইট ব্যান্ড ও ব্ল্যাক ব্যান্ডের মতো রোগ প্রবালের স্বাস্থ্যকে আরও হুমকির মুখে ফেলেছে। এ জন্য দ্রুত একটি কার্যকর 'সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল'-এর প্রয়োজন রয়েছে।

সুপেয় পানির সংকট

দ্বীপে পানীয় জলের সরবরাহ প্রধানত ৭২৭টি অগভীর নলকূপের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু এই পানির মান সর্বত্র একই রকমের নয়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে শৌচাগারের অভাব রয়েছে এবং দ্বীপে কোনও কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নাই। বিদ্যুৎ সরবরাহ মূলত সৌরশক্তি নির্ভর; দ্বীপের প্রায় ৪৫ শতাংশ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্ন সৌরশক্তি নির্ভর বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। তবে ‘উচ্চ ব্যয়’ বিদ্যুৎ সেবার সম্প্রসারণকে সংকুচিত করে রেখেছে।

মাস্টারপ্ল্যানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো একটি সুস্পষ্ট নীতি-নির্দেশনা কাঠামো স্থির করা, নির্দেশনাভিত্তিক ভূমি ব্যবহার এবং সংরক্ষণ নীতির মাধ্যমে দ্বীপের সর্বোত্তম উন্নয়ন সাধন। এ লক্ষ্যে এরকমের একটি পরিকল্পনা দলিল, কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে একটি আইনি ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রধান উদ্দেশ্য

  • বাস্তুতন্ত্র ও প্রজাতি সংরক্ষণ: প্রবাল, ম্যানগ্রোভ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলগুলো সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধার করা।
  • টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনা: মৎস্য, বন ও মিঠাপানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • জলবায়ু ও দুর্যোগ সহনশীলতা: উপকূলীয় সুরক্ষা এবং দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়ানো।
  • নিয়ন্ত্রিত ভূমি ব্যবহার ও উন্নয়ন: বসতি, পরিবেশ-বান্ধব পর্যটন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের জন্য সুনির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ/সংরক্ষণ করা।
  • জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন: উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়ায় স্থানীয় অধিবাসীদের যুক্ত করা।
  • পরিবেশ-বান্ধব পর্যটন ও সবুজ অর্থনীতি: পরিবেশের ওপর কম প্রভাব ফেলে এমন পর্যটন এবং পরিবেশ-বান্ধব ব্যবসা/ উদ্যোগকে উৎসাহিত করা।
  • গবেষণা, শিক্ষা ও সচেতনতা: পরিবেশগত গবেষণা ও জনসচেতনতা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়া।
  • নীতি ও প্রশাসনিক সহায়তা: দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য আইনি ও আর্থিক কাঠামো বাস্তবায়ন করা।