আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) বদলি নিয়ে পুলিশের অন্দরমহলে চলছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। একপক্ষের ‘আবদার’ আরেকপক্ষ মেটাতে পারছে না। তবু নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিষ্ঠাবান ও দক্ষ কর্মকর্তাদের বাছাই করে পদায়নের চেষ্টা চলছে। এজন্য এক মাসেরও বেশি সময় ধরে গোয়েন্দারা পুলিশের আনাচকানাচ খুঁজে দেখেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলেন, তাদের বিষয়েও কর্র্তৃপক্ষ অত্যন্ত সতর্ক।
বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লটারির মাধ্যমে জেলার এসপিদের চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৬৪ জেলার এসপি নির্ধারণ করা হলেও, ১৫ জন বর্তমান এসপিকে বাদ দিয়ে লটারি করার অভিযোগ উঠেছে। বাকি ৪৯ জেলার বর্তমান এসপিদের নাম লটারির তালিকায় রাখা হয়েছে। ফলে একটি অংশ খুশি হলেও পুলিশের বেশিরভাগ সদস্যের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা। ১৫ বছর ধরে যেসব কর্মকর্তা পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তারা এবারও বঞ্চিতই রয়ে গেছেন। পদায়নের চূড়ান্ত তালিকায় তাদের নাম নেই।
এদিকে লটারির মাধ্যমে বদলির কারণে থানার ওসিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রবল আতঙ্ক। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই ওসিদের পদায়নও লটারির মাধ্যমে করা হবে বলে পুলিশ সূত্র নিশ্চিত করেছে। সারা দেশে ৪৬৬টি থানার মধ্যে অনেক ওসি মাত্র তিন-চার মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। ভাগ্য না থাকলে তারাও লটারিতে বাদ পড়ে যাবেন। তাদের মধ্যে অনেকেই অর্থ বা তদবিরের মাধ্যমে থানায় এসেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলার মধ্যে রয়েছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লাসহ আরও কয়েকটি জেলা। এগুলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অপরাধপ্রবণতার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনা, বরগুনা, পিরোজপুরসহ কয়েকটি জেলা। আর ‘সি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে গোপালগঞ্জ, নড়াইল, রাজবাড়ী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ কয়েকটি জেলা।
তিনি আরও বলেন, ‘এ’ ক্যাটাগরির এসপি আবার একই ক্যাটাগরির অন্য জেলায় যাচ্ছেন, ‘বি’ ক্যাটাগরির এসপিও একই ক্যাটাগরির জেলা পাচ্ছেন। তাহলে এই লটারির প্রকৃত অর্থ কী দাঁড়ায়? মূলত ১৫ জন নতুন এসপি নিয়োগের জন্যই লটারি করা হয়েছে। এখানে ২৫, ২৭ ও ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের নেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতার দিক থেকে ২৫ ব্যাচ এগিয়ে থাকলেও অভিযোগ উঠেছে, তাদের পাশ কাটিয়ে ২৭ ও ২৮ ব্যাচের তরুণ কর্মকর্তাদের লটারিতে আনা হয়েছে। যাদের মাঠপর্যায়ে জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের মতো পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতা এখনো তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, একজন এসপির সামাজিক-রাজনৈতিক সেন্টিমেন্ট বোঝার সক্ষমতা এবং আইন প্রয়োগে সংযম থাকা অত্যন্ত জরুরি। তরুণ কর্মকর্তারা অনেক সময় আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নেন, যা পরে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনে জেলার এসপি পদায়নে লটারি করা নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অনেকে বলেছেন, লটারিতে যে ক্যাটাগরি নির্ধারণ হয়েছে সেখানে স্বচ্ছতা নেই। কারণ, যারা ‘এ ক্যাটাগরির’ জেলায়, তারা সেই জেলার থেকে ‘এ ক্যাটাগরির’ অন্য জেলায় যাচ্ছেন। এ ছাড়া লটারির তালিকায় অনেক বঞ্চিতদের রাখা হয়নি। যারা নির্বাচনের আগে জেলায় পোস্টিং পেতে মুখিয়ে ছিলেন। আবার লটারিতে ফ্যাসিস্টদের সুযোগ পাওয়া সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল অনেক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে ক্ষোভ ও হতাশার এ চিত্র উঠে আসে। লটারি করে পদায়নের ফল ভালো আসে না বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরাও। কারণ, একটি জেলার দায়িত্বপালনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেক বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়। তার মধ্যে জেলায় কাজ করার অভিজ্ঞতা একটি বড় বিষয়, যা হয়তো অনেকের মধ্যেই নেই। ফলে নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে বেগ পাওয়া লাগতে পারে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বাছাই করা কঠিন। গুরুত্বপূর্ণ জেলায় সাধারণত অভিজ্ঞ ও নিষ্ঠাবানদের পোস্টিং দেওয়া হয়। লটারিতে যদি অনভিজ্ঞ কেউ গুরুত্বপূর্ণ জেলায় যান, তাহলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, ‘লটারির মাধ্যমে পদায়ন ভালো কোনো উদাহরণ তৈরি করবে না। এমনকি লটারি করে পদায়নের ফলও ভালো আসে না। মূলত নিজেরা যোগ্য লোককে বাছাই করতে পারছি না বলেই লটারি করছি। একেক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা অপরাধের ধরন ভিন্ন। সেখানে নতুন একজনের গিয়ে কাজ করা কঠিন। কাজের দক্ষতা বিবেচনায় পদায়ন করাটাই ভালো। লটারির জন্য আগামী দিনে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। কারণ, লটারিতেও অনিয়ম করা সম্ভব। এসপি হোক আর ডিসি হোক, লটারির ওপর নির্ভর করাটা ভালো কোনো প্রক্রিয়া নয়। এতে করে যেটা হবে, অন্যরা তাদের পছন্দের লোককে লটারির মাধ্যমে পদায়ন করবে। এতে করে যোগ্য লোকেরা পদায়নবঞ্চিত হবেন। মনে রাখতে হবে সবকিছু লটারি করে হয় না। এমন কর্মকর্তার পদায়ন হোক, যিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবেন। ব্যক্তি ও সমাজ জীবন আর পেশাগত পদায়নের লটারি তো এক নয়। পেশাগত পদায়নের ক্ষেত্রে লটারি কখনোই গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে না। এটা ভালো কোনো উদাহরণ হলো না।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার যমুনা ভবনে প্রধান উপদেষ্টা লটারির উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, ভারপ্রাপ্ত আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীসহ মন্ত্রণালয় ও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ৬৪ জেলার মধ্যে বর্তমান ১৫ জন এসপিকে বাদ দিয়ে নতুন ১৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৯ জনকে অন্য জেলায় বদলি করা হচ্ছে। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
সূত্র আরও জানায়, গত শনিবারের বৈঠকে ৬৪ জেলাকে ‘এ’ (২৭টি), ‘বি’ (২৮টি) ও ‘সি’ (৯টি) ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। লটারির মাধ্যমেই চূড়ান্ত হয়েছে কে কোন জেলায় যাবেন। এই এসপিরা আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) এ কে এম আওলাদ হোসেন বলেন, সোমবার যমুনায় লটারির মাধ্যমে ৬৪ জেলার এসপি চূড়ান্ত হয়েছে। সরকারি আদেশ পেলে পদায়ন করা হবে।
একজন ডিআইজি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লটারির কারণে সম্প্রতি এসপি পদে নিয়োগ পাওয়া ছয়জনকে যোগদান থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ১৫ বছর ধরে ডাম্পিং পোস্টিংয়ে থাকা বঞ্চিত কর্মকর্তারাও তালিকায় আসেননি। ফলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। পরবর্তী ধাপে ওসি নিয়োগও লটারিতে হবে। সেখানেও একই পরিস্থিতি হলে বিতর্ক এড়ানো কঠিন হবে।
রেঞ্জ ডিআইজি, মহানগর পুলিশ কমিশনার ও উপকমিশনারদের বদলির বিষয়েও সিদ্ধান্ত আসছে। তাদের ক্ষেত্রে লটারি হবে কি না, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।