Image description

আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রীসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রকল্পে অফিসিয়ালি-আনঅফিসিয়ালি ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে এর মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সরকারের অর্থ, ব্যাংকের অর্থ এমনকি অন্য ব্যবসায়ীদের অর্থও লুট করেছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। এসব অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল হোটেল, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও জমিজমাসহ সম্পদের পাহাড়। বিভিন্ন দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছেন ওবায়দুল করিম দুবাইয়ে।

জানা গেছে, ওবায়দুল করিমের নামে দুবাইয়ে যেসব সম্পদ রয়েছে, তার কোনোটিই তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেনা হয়নি। দুবাইয়ে চার তারকা মানের একটি হোটেল কেনার রেজিস্ট্রেশন নথিতে তিনি নিজেকে আলবেনিয়ার নাগরিক পরিচয় দিয়েছেন। আলবেনিয়ার করপোরেট রেজিস্ট্রির নথিতে তার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি অ্যাগ্রি প্রোডাক্টসে ইউরোপের নাম উল্লেখ রয়েছে। যা ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমের মাধ্যমে তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে আলবেনিয়া। একটি বিনিয়োগ কর্মসূচির অধীনে তাকে নাগরিকত্ব পাইয়ে দিয়েছে সাইপ্রাস সরকার। এ ক্ষেত্রে তাকে সাইপ্রাস সরকারের গবেষণা ও ভূমি উন্নয়ন তহবিলে ২ লাখ ইউরো বা প্রায় আড়াই লাখ ডলার এবং সাইপ্রাসের রিয়েল এস্টেটে প্রায় ২০ লাখ ইউরো বা প্রায় ২৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হয়েছে।

এদিকে বাহরাইনে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডের। ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে সালমান এই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন। তবে সেখানে তার ছেলেকে বাংলাদেশি হিসেবে বলা হলেও ওবায়দুল করিমকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোম্পানিটি ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়।

ওবায়দুল করিমের মেয়ে জারিন করিম সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি জেশা জেনারেল ট্রেডিং এলএলসির মালিক, যেখানে তাকে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিমের রয়েছে ডোমিনিকান পাসপোর্ট। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর এই পাসপোর্ট ইস্যু করেছে সেই দেশ। তাদের মেয়ে জারিন করিম ২০২৪ সালে ডোমিনিকার সম্মানসূচক কনসাল হিসেবে বাংলাদেশে নিয়োগ পান এবং তিনি এখনো এই পদে রয়েছেন। জারিন করিমও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের নাগরিকত্ব পেতে সে দেশের রিয়েল এস্টেট খাতে ২ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন।

এদিকে দুবাইয়ের ‘প্যালেট রয়েল রিফ্লেকশন হোটেল অ্যান্ড স্পা’ নামের চার তারকা হোটেলের মালিকানায় ৪৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ওবায়দুল করিমের। ২০১৪ সালে নির্মিত এই ১০০ কক্ষের হোটেলটি দুবাইয়ের অভিজাত এলাকা বার দুবাইয়ে অবস্থিত। ওবায়দুল করিম, তার স্ত্রী আরজুদা করিম ও মেয়ে জারিনের নামে দুবাইয়ের আল মেরকাধ ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার রেসিডেন্সে দুটি বাড়ি ও তিনটি বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। সব মিলিয়ে দুবাইয়ে ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া বিলাসবহুল গাড়িসহ অস্থাবর সম্পদ রয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার।
দুবাইয়ে বিশাল সম্পত্তি গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হাজার কোটি টাকার পুরোটাই প্রতারণা, জালিয়াতি ও আত্মসাতের মাধ্যমে অর্জন করেন ওবায়দুল করিম। এর মধ্যে ঢাকার মতিঝিলে ৪১ তলাবিশিষ্ট সিটি সেন্টার নির্মাণের সময় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে লিড কোম্পানি বেলহাসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদ আহমেদের সই জাল করে একটি ব্যাংক থেকে তিন দফায় অন্তত ১৭৬ কোটির ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। ওবায়দুল করিম জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিলেও খেলাপির তালিকায় উঠে আসে বেলহাসার নাম। অথচ বেলহাসার কেউই জানতেন না যে তাদের কোম্পানির নামে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন ওবায়দুল করিম। ঋণ না নিয়েও ওবায়দুল করিমের খপ্পরে পড়ে খেলাপির তালিকায় নাম আসে বেলহাসার। ওই সিটি সেন্টারে বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্ট্রাক্টিং কোম্পানির ৬০ শতাংশ শেয়ার থাকলেও শেয়ারধারীদের অজ্ঞাতে ওবায়দুল করিম একাই গোপনে ২২টি ফ্লোর বিক্রি করে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেন।

এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান উড়ালসেতু নির্মাণের সময় নির্মাণকারী হিসেবে ওরিয়ন ও বেলহাসার যৌথ প্রতিষ্ঠান বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের কোম্পানি মেমোরেন্ডাম জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এখানে সম্পূর্ণ জালিয়াতির মাধ্যমে গোপনে কোম্পানির মেমোরেন্ডামে বেলহাসার প্রতিনিধি বাদ দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্ট্রাক্টিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদ আহমেদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ওবায়দুল করিম স্বাক্ষর জাল করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বেলহাসার প্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। মামলায় ওবায়দুল ছাড়াও তার ছেলে সালমান করিম, জামাই মেহেদী হাসানকে আসামি করা হয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র, জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রার, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সেক্রেটারিকে মোকাবিলা বিবাদী করা হয়। এতে ওবায়দুল করিম বেলহাসার বিনিয়োগ করা ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ আনা হয়।
জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একে একে সাতটি পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন ওবায়দুল করিম। আবার সরকারকে কোনো বিদ্যুৎ না দিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আত্মসাৎ করেছেন আরও সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। ওবায়দুল করিম এভাবে দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে আত্মসাতের সমুদয় টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
শীর্ষনিউজ