নির্মম জুলাই। স্বজন হারানোর কতো কাহিনী। কতো শত মানুষের লাশ। পঙ্গু আহতদের আর্তনাদ। বেওয়ারিশ লাশের লম্বা লাইন। এখনো পুলিশ স্টেশন, হাসপাতালের মর্গ ও কবরস্থানে স্বজনদের ছুটে চলা। সবাই অন্তত নিখোঁজ প্রিয়জনের লাশটা ফেরত চান। তবে কেউ খোঁজ পাচ্ছেন। কেউ আবার খুঁজতে এসে না পেয়ে পাহাড়সম ব্যথা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। চব্বিশের জুলাই লাখো মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে গেছে। এমনই ক্ষত নিয়ে প্রতিদিন রায়ের বাজার কবরস্থানে ছুটে আসেন এক মা। তিনি নিজে কাঁদেন, অন্যদেরও কাঁদান। বেওয়ারিশ কবরের সারিতে সকাল-সন্ধ্যা কাঁদেন। রাতে আবার বাড়ি ফিরে যান। প্রতিদিন এসেই একে ওকে প্রশ্ন করেন ছেলে সোহেলের কবর কোনটা? এখানেই শত কবরের ভিড়ে হারিয়ে গেছে সোহেল রানা। তবে বেওয়ারিশদের কেউ কেউ ওয়ারিশ খুঁজে পেলেও কে কোন কবরে শুয়ে আছেন তা কেউ জানেন না। বেওয়ারিশ পরিচয় নিয়ে রায়ের বাজার কবরস্থানে দাফন হওয়া ১১৪ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জনের পরিচয় মিলেছে। বাকি ১১০টি মরদেহের কোনো ওয়ারিশই নেই। কেউ তাদের খোঁজও করতে আসেন না বলে জানিয়েছেন রায়ের বাজার কবরস্থান ও আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কর্মকর্তারা। এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে বেওয়ারিশ এই শতাধিক লাশের স্বজনরা কোথায়। আদৌ কি তাদের পরিচয় শনাক্ত হবে? তারা কি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন? নাকি বেওয়ারিশ হিসেবেই সমাহিত থাকবেন। এ নিয়ে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনও বিপাকে। তবে ইতিমধ্যে জুলাই আন্দোলনে নিখোঁজদের সন্ধান দিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি সেল। এদিকে পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পরও সন্তানের কবর শনাক্ত করতে পারছেন না তারা। গেল ৫ মাস ধরে সরকারের বিভিন্ন মহলে ঘুরেও কবর শনাক্তের কোনো উপায় জানতে পায়নি ওই ৪ পরিবার। তাদের দাবি, জুলাই ফাউন্ডেশনে কয়েক দফা যোগোযোগ করেও কোনো সুরাহা মিলছে না।
জানা গেছে, গত ১৮ই জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সোহেল রানা। ১৯শে জুলাই সোহেলের লাশ ঢামেকের মর্গে আনে পুলিশ। ৫ দিন পর মর্গ থেকে লাশ নিয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। পরে আঞ্জুমানে এসে ছেলের ছবি দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়। একইভাবে উত্তরার ফয়সাল সরকার ও মো. আসাদুল ইসলাম, গোপিবাগের রফিকুল ইসলামের লাশ শনাক্ত করেন তাদের পরিবার। তবে কেউই এখনো কবরের সন্ধান পাননি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল ও শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা বেওয়ারিশ লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ডিএনএ নমুনা রেখে স্ব-স্ব থানার মাধ্যমে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে পাঠায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম ওই বেওয়ারিশ মরদেহের ছবি সংরক্ষণ করে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করে। ওই সময়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ থেকে ১২টি পর্যন্ত লাশ দাফন করা হয়।
আঞ্জুমানের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া লাশের পরিচয় পাওয়া গেলেও লাশ শনাক্ত করা কঠিন। আসলে সন্ধান পেলেই এখন লাশ পাওয়া সম্ভব না। ওখানে গণহারে কবর দেয়া হয়েছে। কাকে কোন কবরে দাফন করা হয়েছে, এটা জানার কোনো সুযোগ নেই। এখন কার কবর কোনটা তা কীভাবে বুঝবেন? এটা খুবই জটিল কাজ। এখন পর্যন্ত ৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে কোনটি তাদের স্বজনের কবর তা জানতে পারেনি। ৪ জনের লাশ নিতে হলে ১১৪ জনের লাশই তুলতে হবে। তারপরে ওই ১১৪ জনের ডিএনএ স্যাম্পল নিতে হবে। তারপরে তাদের স্বজনের সঙ্গে মেলাতে হবে। তাছাড়া পরিচয় শনাক্ত করার অন্য কোনো উপায় নেই। আর ১১৪ জনের লাশ তোলা ওতো সহজ নয়। এখানে আইনি সমস্যা রয়েছে। চাইলেই লাশ তোলা যায় না। সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ নিতে হলে কয়েক বছর সময় লাগবে। তবে সরকার চাইলে সহজেই সম্ভব।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কাজী গোলাম মোখলেছুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এখন বেওয়ারিশদের ওয়ারিশ শনাক্ত চ্যালেঞ্জিং। মেডিকেলে প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা আছে। তবে তা কোনো কাজে আসবে না। কারণ কোন কবরে কাকে দাফন করা হয়েছে, তা জানা মুশকিল। এখন সবগুলো বডি তুলে পুনরায় ডিএনএ করাতে হবে। তারপরে স্বজনের সঙ্গে ম্যাচ করাতে হবে। এটা পুলিশের কাজ।
ওই বিভাগের আরেক শিক্ষক মানবজমিনকে বলেন, দাফনের সময় কোনো সিরিয়াল মেইনটেন করা হয়নি। ওই পরিস্থিতিতে প্ল্যানিং মতো কাজ করাও সম্ভব ছিল না। দাফনের সময় হাসপাতাল থেকে দেয়া ডিএনএ নমুনার একটি সংকেতিক চিহ্ন যদি প্রতিটি কবরে একটি প্লেকার্ড টাঙিয়ে দেয়া হতো, তাহলে কেউ দাবি করলে তাদের ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে কবরে টাঙানো ওই প্লেকার্ডের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে ম্যাচ করলেই হয়ে যেতো। এটা সহজেই সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন একজনের লাশ নিতে হলে ১১৪ জনের লাশ তুলতে হবে। এটা প্রায় অসম্ভব।
রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ইনচার্জ মাওলানা ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কাছে লাশ এসেছে। আমরা দাফন করেছি। লাশের কাফন খুলে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আর কে কোনো কবরে তা আমাদের জানা নেই। যদি একটি সিরিয়াল মেনে এবং কোনো চিহ্ন দিয়ে দাফন করা যেতো, তাহলে এখন ডিএনএ করার জন্য আবার লাশ তুলতে হতো না। ওই সময়ে এমন পরিস্থিতি ছিল না।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা বিভাগের প্রধান কামরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, অনেকে ছবি দেখে শনাক্ত করছেন। যারা আসছেন আমরা সবাইকে ছবি দেখাচ্ছি। ৪ জন ছবি দেখে শনাক্ত করেছে। তবে এখন লাশের পরিচয় খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ নয়। বেওয়ারিশ লাশের ময়নাতদন্ত ও ডিএন নমুনা রেখেই দাফন করতে আঞ্জুমানে দেয়া হয়। আঞ্জুমান সেই লাশের একটি ছবি তুলে রাখেন। পরে সরকার নির্ধারিত কবরস্থানে দাফন করা হয়। দাফনের সময় কোনো ক্রমিক নম্বর ও শনাক্ত চিহ্ন রাখা হয় না। এতে করে লাশের সন্ধান পেলেও লাশ কোন কবরে আছে তা বলা মুশকিল। জুলাই আন্দোলনে নিহতদের খোঁজে গত ৩০শে জুলাই থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ ব্যক্তি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে এসেছেন।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সিনিয়র সহকারী সচিব মাহবুব উল্যাহ মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের কাকে কোন কবরে দাফন করা হয়েছে এই তথ্য নেই। তাই পরিচয় পাওয়ার পরে বডি নিতে পারছে না। আমরা কাজ করছি। দেখি কি করা যায়। এতগুলো বেওয়ারিশ লাশ কিন্তু তাদের দাবিদার নেই। এটাও একটি জটিল বিষয়। দাবিদার না থাকলে তাদের লাশ তুলে কাকে দিবো? তবে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের লাশ ফেরত দিতে কাজ করছি। দেখি কতোদূর করা যায়।
জানা গেছে, গত ২২শে জুলাই থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম রায়ের বাজার কবরস্থানে ১১৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। এরমধ্যে ২২শে জুলাই একদিনেই ১১টি লাশ দাফন করা হয়। এরপর ২৩শে জুলাই ১টি, ২৪শে জুলাই ৯টি, ২৫শে জুলাই ৩টি, ২৭শে জুলাই ৭টি, ২৮শে জুলাই ১১টি। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ২৮শে জুলাই থেকে ১২ই আগস্ট পর্যন্ত ১৫ দিনে রায়েরবাজার কবরস্থানে আঞ্জুমান কোনো বেওয়ারিশ লাশ পাঠায়নি। পরে আঞ্জুমানে গেলে তারা বলেন, এই সময়ে তাদের কাছে কোনো বেওয়ারিশ লাশ আসেনি। কোনো হাসপাতাল থেকেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তবে ১২ই আগস্ট ২টি, ১৯শে আগস্ট ৮টি, ২১শে আগস্ট ৭টি, ২২শে আগস্ট ৩টি, ২৬শে আগস্ট ৩টি, ৩১শে আগস্ট ১০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়।