Image description

‘কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে যায়। এই বুঝি ব্যথাও অভ্যাস হয়ে যায়’– আসলেই কি তাই? ফিরোজা বেগম তো কাঁদছেন ১৩ বছর ধরে। রোগে শয্যাশায়ী মা প্রতি রাতেই ভাবেন, এই বুঝি এসে কলিজার টুকরা দুই ছেলে দরজা নক করবে, মা বলে ডাকবে।

অপেক্ষা করতে করতে এখন কাঁদতেও ভুলে গেছে স্বজন। ক্যালেন্ডারের পাতা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ফেরে না ফিরোজ খান কালু ও মিরাজ খান। ২০১২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে মিরাজকে ঢাকার মিরপুর; কালুকে চট্টগ্রাম থেকে তুলে নেওয়া হয়। এর পর থেকেই স্বজনের বুকের যন্ত্রণা জমে হয়েছে হাহাকার। আজও শেষ হয়নি বিচারহীনতার গল্প।

২০১২ সালের ৩ এপ্রিল মিরাজকে যখন বন্ধুদের আড্ডা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তখন বয়স ছিল ১৬ বছর। স্বজন ও গুম কমিশনে দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, ওই রাতে একটি সাদা রঙের (সিলভার কালার) হায়েজ মাইক্রোবাসে এসে ৮-১০ জন মিরাজকে তুলে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলে চোখে কালো কাপড়ে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। সহ্য করতে না পেরে মিরাজ বলেছিল, ‘স্যার, আর মারিয়েন না।’ আর্তনাদের জবাবে অপহরণকারীরা ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘স্যার না, বস বল।’ সেই রাতের পর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও মিরাজের কোনো হদিস পায়নি পরিবার।

মিরাজের জন্য কাতর ফিরোজা বেগমের পরিবারে মাত্র চার মাসের মাথায় আসে আরেক আঘাত। ২০১২ সালের ২৪ আগস্ট চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার ঈদগাহ মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হন ফিরোজ খান কালু। পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়াতেই একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো চ-১৫-৯৯০৯) এসে থামে। গাড়িতে ‘ডিবির’ স্টিকার লাগানো থাকলেও অপহরণকারীরা নিজেদের র‍্যাব পরিচয় দেয়। কালুকে যখন জোর করে গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তখন স্থানীয় এক বোবা লোক দৌড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তাকে লাথি মেরে কালুকে নিয়ে যায় তারা।

কালু নিখোঁজের আগে তাঁর পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়। তৎকালীন র‍্যাব কর্মকর্তা ও এনটিএমসির বরখাস্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এ হুমকি দিয়েছিলেন। কালুর স্ত্রী আমেনা আক্তার বৃষ্টি জানান, গুম করার কিছুদিন আগে জিয়াউল আহসান ফোন করে বরিশালের বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান সারওয়ারকে কালুকে অপহরণের বিষয়ে বলেছিলেন।

আজ রবিবার (২৩ নভেম্বর) কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমেনা সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্ট্রিমকে বলেন, সারওয়ার ভাই সে সময় আমাকে বলেছিলেন– জিয়াউল আহসান তাঁকে ফোন করেন। এরপর বলেছেন, কালু তো চট্টগ্রামে আছে। আমাদের কাছে নিউজ আছে। একটি তালিকা হয়েছে, যাদের নাম আছে সবাইকে একে একে ধরা হবে। কালুর নামও তাতে আছে। যেভাবেই হোক ওকে আমাদের ধরতে হবে।

এ ব্যাপারে আজ ররিবার মজিবুর রহমান সারওয়ার স্ট্রিমকে বলেছেন, বিএম কলেজের দিকে একটি হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। জিয়াউল আহসান আমাকে ফোন করে দাবি করেছিলেন– ফিরোজ খান কালু ওই ঘটনায় জড়িত। তিনি আমার কাছে কালুর অবস্থান জানতে চান এবং তাঁকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা চান।

তিনি বলেন, ‘আমি তখন জিয়াউলকে বলেছিলাম– কালু কোথায় আছে জানি না। অন্যের সন্তানের খোঁজ আমি কীভাবে দেব? কারও ছেলেকে ধরিয়ে দিতেও আমি পারব না। আমি উনাকে কোনো খোঁজ দিইনি।’

এ প্রসঙ্গে আমেনা বলেন, ‘জিয়াউল আহসানের সেই তালিকার সূত্র ধরেই দেবরের পরে আমার স্বামীকে তুলে নেওয়া হয়।’ আমেনা জানান, ওইদিন চোখের সামনে কালুকে তুলে নিয়ে যেতে দেখেও কোনো আইনি সহায়তা পাননি তিনি।

ওইদিন হালিশহর থানার এসআই জাবেদ ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন। অপহরণে ব্যবহৃত কালো মাইক্রোবাসের নম্বর টুকে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু থানায় যাওয়ার পর এসআই জাবেদ একান্তে ডেকে আমেনাকে বলেন, ‘গাড়ির নম্বর টুকেছি। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারব না। এরা আইনের লোক, আমিও আইনের লোক’।

 

হালিশহর, ডবলমুরিং থানাসহ র‍্যাব, ডিবি ও সিআইডির দপ্তরে দপ্তরে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাননি আমেনা। কেউ মামলা নেয়নি, বাধ্য হয়ে শুধু একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে ফেরেন বাসায়। স্বামীকে না পাওয়ার পরে সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক হয়রানি।

আমেনা জানান, বরিশালে গ্রামের বাড়ির জমিজমা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দখল করেন। প্রতিবাদ করলে বৃদ্ধ শাশুড়িকে তারা মারধর করেন। ভয়ে সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি মঠবাড়িয়ায় আশ্রয় নেন আমেনা। দীর্ঘ আট বছর ‘স্বেচ্ছা আত্মগোপন’ করার পর ২০২০ সালের শেষদিকে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আমেনার খোঁজ নেয়। তাদের সহযোগিতায় আইনি ও মানসিক সাহস সঞ্চয় করে। পরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজপথে নামেন আমেনা।

কালুকে অপহরণের সময় তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ আল জিসানের বয়স ছিল তিন বছর। বাবার কোনো স্পষ্ট স্মৃতি তার মনে নেই। ১৬ বছরের এই কিশোর এখন নবম শ্রেণির ছাত্র। দীর্ঘ ১২ বছর বাবাকে ছাড়া বড় জিসান মাকে প্রায় প্রশ্ন করে, ‘সবাই তো ফিরে আসছে, আমার বাবা কবে আসবে? ওরা কি বাবাকে মেরে ফেলেছে?’ ছেলের প্রশ্নের উত্তর নেই আমেনার কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কষ্টকে চেপে রাখেন তিনি।

স্বামী ও দেবরের অনুপস্থিতির সঙ্গে চরম অর্থকষ্টে চলছে আমেনার জীবন। দুই ছেলের জন্য ফিরোজা বেগম এখন শয্যাশায়ী, কান্না করতেও ভুলে গেছেন। শাশুড়ির ঠিকমতো চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছেন না আমেনা।

ঢাকায় একটি ছোট চাকরি করে কোনো মতে সংসার টানা আমেনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও গুম কমিশনের দিকে তাকিয়ে। তাঁর একটিই দাবি, জিয়াউল আহসানসহ যারা তাঁর স্বামী-দেবরের গুমের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার হোক। কালু ও মিরাজ বেঁচে আছে কিনা, তা জানতে চান মা ফিরোজা। দুই ছেলের মুখ দেখেই তিনি মরতে চান।