১৯ নভেম্বরের গভীর রাত। শীত ঠিক পুরোপুরি নামেনি, তবু বাতাসে একটা ঠান্ডা খচখচে ভাব। শহরটা যেন ঘুমের ভিতরেও ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। এমন সময় হঠাৎ আমার দরজায় অচেনা কড়া। প্রথমে ভাবলাম হয়ত ভুল দরজা। কিন্তু দ্বিতীয় কড়া আরো কঠিন, আরো স্পষ্ট। বুঝিয়ে দিল, এ রাতের ছন্দ বদলে গেছে। দরজা খুলতেই দেখি কয়েকজন অপরিচিত মুখ। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ডিবি পরিচয়ে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের কঠোর নির্দেশ ও নিয়ম অনুযায়ী কাউকে আটক করতে হলে স্থানীয় থানাকে জানানো বা আইডি কার্ড প্রদর্শনের যে বিধান রয়েছে, তার কোনোটিই মানা হয়নি। উল্টো ডিবির প্রধান শফিকুল ইসলাম আমার সঙ্গে কথা বলবেন, এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘড়ির কাঁটা এক জায়গায় আটকে থাকার মতো সময় যেন থমকে গেল। প্রশ্ন, নীরবতা, অপেক্ষা সবকিছু মিশে প্রায় সাড়ে ১০ ঘণ্টা ডিবি হেফাজতে স্তব্ধ থাকলাম।
এসব গল্প এখন পুরনো। তবে ডিবি থেকে বাসায় ফেরার পর একটি অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলাম। সবার মুখে একটাই কৌতূহলী প্রশ্ন- ‘ডিবিতে আপনার খাবার মেন্যুতে কী ছিল?’ বিদেশি একটি গণমাধ্যম আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়ও এই প্রশ্ন করেছে। গতকাল একটি টেলিভিশনের টক-শোতেও দেখলাম আমার খাবার মেন্যু নিয়ে বিজ্ঞরা আলোকপাত করছেন! এমনকি ফেসবুকের জনপ্রিয় পেজ ‘ইয়ার্কি’ পর্যন্ত রসিকতা করে লিখেছে ‘ভাতের হোটেল সার্ভিস বন্ধ, ডিবি এখন ‘‘উঠাও’’ সার্ভিস চালু করেছে।’ আসলে আমরা বাঙালিরা বড্ড ভোজনরসিক। সুখে খাই, দুঃখে খাই, প্রেমে পড়লে খাই, ছ্যাঁকা খেলে খাই, কেউ জন্ম নিলে খাই, মারা গেলেও খাই... শুধু খাই আর খাই। হয়তো এই সাইকোলজি বুঝেই ডিবি হারুন ‘ভাতের হোটেল’ খুলেছিলেন। তাই আমার আটকের পর সবার আগ্রহ ছিল, হারুনের হোটেলের ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার পর নতুন মেন্যুতে কী যোগ হলো?
মেন্যু আইটেম ১: পানি।
বাসা থেকে ডিবি কার্যালয়ের দূরত্ব খুব বেশি না, কিন্তু অনুভূতিতে সেটা যেন একটা যুগ। কারণ অন্ধকার রাতে অজানা যাত্রা সবসময় বুকের ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি করে। আমাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর পরই ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। তড়িঘড়ি করে আসামির খাতায় নাম তুলে, বেল্ট-জুতা খুলে শরীর তল্লাশি করে আসামিদের গারদে ঢোকানো হয়। ডিবির লোকজনের রুক্ষ ব্যবহার আর ধমকে আমি তখন রীতিমতো চোখে সরষে ফুল দেখছি। গারদের ভেতরে অচেনা মুখ। কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, কী মামলায় আইছেন?’ আমি তো জানিই না কেন এসেছি! আমার অজ্ঞতা দেখে আরেক বন্দি রায় দিলেন, ‘তাইলে নিশ্চিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হবে আপনার নামে।’ ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, কথা বের হচ্ছে না। আমি পানি চাইলাম। কেউ একজন পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। ডিবিতে আমার প্রথম খাবার, এক চুমুক পানি।
কিছুক্ষণ পর ডিবির প্রধান এসে আমার সঙ্গে কথা বললেন। এরপর আবার আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। দ্বিতীয়তলায় তার রুমে যাওয়ার পর আমাকে দাঁড় করিয়ে পরেরদিন প্রেস কনফারেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলেন। তখন আমি আসল কারণ জানতে পারলাম কেন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আমন্ত্রণপত্রে আমার নাম্বার নাকি ভুলভাবে দেয়া হয়েছে এ জন্য আমাকে ডেকেছেন। ডিএমপি মিডিয়া সেল থেকে আরো একধাপ এগিয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আমার নাম্বার নাকি সংবেদনশীল জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছিল বলে আমাকে রাতের অন্ধকারে উঠিয়ে আনা হয়েছিল। যদিও আমি তাদের বলেছিলাম, ভুল করে আমার নাম্বার ব্যবহার হয়নি, আমি জেনে, বুঝে, সুস্থ মস্তিষ্কে এই নাম্বার আমন্ত্রণপত্রে দিয়েছিলাম, যাতে কোনো সাংবাদিক চাইলে প্রেস কনফারেন্স ইস্যুতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এটা যে আমার পাবলিক রিলেশনস এজেন্সি টাইমস পিআর-এর ইনভাইটেশন সেটা আমন্ত্রণপত্রের উপরে আমার প্রতিষ্ঠানের লোগো থাকার পরেও হয়তো তারা বুঝতে পারেনি।
মূলত তারা এই প্রেস কনফারেন্স করতে দিতে চান না। একটি সিন্ডিকেটকে মনোপলি ব্যবসা করার সুযোগ দেয়ার জন্য নীতিগত যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে বিরাট সংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাবেন। যারা দেশের আইন মেনে, লাইসেন্স নিয়ে, সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে প্রকাশ্যে ব্যবসা করেন। এমনকি সরকারি ব্যাংক তাদের ব্যবসার বৈধতা যাচাই-বাছাই করে ঋণও দেয়। তারা ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্টার (এনইআইআর)-এর বিরুদ্ধে না। শুধু এনইআইআর বাস্তবায়নে অন্য বড় ব্যবসায়ীদের মতো নিজেদের ব্যবসা করার সমান সুযোগ চান। এ বিষয়ে নিজেদের মতামত, প্রস্তাবনা ও দাবির কথা সাংবাদিকদের বলবেন, সেটা উপর মহল নিতে পারবেন না কেন? এ দেশের মানুষকে কথা বলার অধিকার তো সংবিধানই দিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করে এই কথা বলার অধিকার হরণ করেছিল। সেটা এই সরকার বাতিল করেছে বলে দাবি করলেও একই কায়দায় কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা কার স্বার্থে করা হচ্ছে? শুধু মতামত দিবে বলে তাদের মুখ চেপে ধরতে হবে? তাদের কথা বলতে দেয়া যাবে না? এই যে ডিবির নতুন প্রধান বা যে বিশেষ সহকারীর দিকে অভিযোগের তীর যাচ্ছে, তারাও এসব পদে এসেছেন আগের সরকারের সময়ে কেউ কথা বলতে চাইলে তাদের মুখ চেপে ধরতো বলে। অথচ গদিতে বসেই তারা সব ভুলে গেলেন!
ডিবির প্রধানের সঙ্গে আমার কথা বলা শেষ হওয়ার পর তিনি একজন ডিসিকে বললেন, ‘উনাকে ভাত-টাত খাওয়ায়ে ছেড়ে দিয়েন।’ এটা শুনে আমার মাথায় সঙ্গে সঙ্গে ডিবি হারুনের সেই ‘ভাতের হোটেল’ ভর করল। ডিবি হারুনের ভাতের হোটেল কি তাহলে এখনও খোলা? ভাতের হোটেলে মেন্যুতে কি কি আছে? এত রাতেও কি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত পাওয়া যাবে? এসব ভাবতে ভাবতে হেঁটে ডিসির রুমে পৌঁছে গেলাম। ডিসি আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। কী খাবেন? জানতে চাইলেন তিনি। আমার গলা তখনও শুকনো। শুধু পানি চাইলাম। আরেক দফা পানি খেলাম। তবে আমি ডিনার করতে একদম আগ্রহ দেখালাম না।
মেন্যু আইটেম ২: চীনা বাদাম।
ডিসি আমাকে জানালেন তিনি অনেক ক্ষুধার্ত। একজনকে ডেকে ভাত আনতে বললেন। সে বললো, ‘স্যার এখন তো ভাত পাওয়া যাবে না। তবে মগবাজারে খিচুড়ি পাওয়া যাবে।’ ডিসি তাকে দুই প্যাকেট খিচুড়ি আনতে বললেন। আমার ক্ষুধা থাকলেও একদম খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল না বলে বিনয়ের সাথে আমার খাবার আনতে না করলাম। খাবার এলো। ডিসি ডিনার করলেন। অনেকটা সময় ধরে আমার সঙ্গে নানান বিষয়ে গল্প করলেন। তিনি আগের রাতেও নাকি ঘুমান নাই। খুবই ক্লান্ত, কিন্তু আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য ভোর রাত পর্যন্ত আমার পাশে ছিলেন। রাত তিনটার দিকে একটা চীনা বাদামের কৌটা ধরিয়ে দিলেন। তিনি কয়েকবার বলার পর কিছুটা নিলাম।
এই সময়ে আমি মনে করিয়ে দিলাম আমাকে ছাড়বেন কখন? তিনি একবার বললেন, ‘মোবাইল ব্যবসায়ীদের একজনকে ধরতে পারলে আপনাকে ছেড়ে দিবো।’ কিছুক্ষণ পর স্মার্টফোন ও গ্যাজেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ (এমবিসিবি)-এর সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ পিয়াসকে ডিবি নিয়ে আসলো। আমি বললাম এবার আমাকে ছাড়ুন। তিনি বললেন, ‘সংগঠনের সভাপতি মো. আসলামকে পাওয়া যায়নি। উনি হলে আপনাকে ছাড়তে পারতাম।’ এর আধা ঘণ্টা পর তিনি আবার বললেন, ‘আপনাকে একটা মুচলেকায় স্বাক্ষর করিয়ে ছেড়ে দিবো। সেখানে লেখা থাকবে আপনাকে কোনো টর্চার করা হয়নি, ভুল বোঝাবুঝির কারণে আপনাকে নিয়ে আসা হয়েছিল।’ একজনকে ডেকে এই মুচলেকা লিখতে বললেন। আরো আধা ঘণ্টা পর মুচলেকা এলো। কিন্তু এবার ডিবির প্রধান ফোন ধরছেন না। ঘুমিয়ে গেছেন বলে এটা সম্ভব হচ্ছে না। এরপর তিনি আমাকে অন্য একজনের জিম্মায় দিয়ে ফজর আজানের পর বাড়ি গেলেন।
মেন্যু আইটেম ৩: কফি।
সারা রাত নানা নাটকীয়তা শেষে দিনের আলো ফুটে গেল। আশরাফুল নামের যে পুলিশ সদস্য আমাকে তুলে এনেছিলেন, তিনি বাসা থেকে ফ্রেশ হয়ে এখন ডিবি কার্যালয়ে আসলেন। ততক্ষণে অনেক গণমাধ্যমে আমাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আশরাফুলের নামও এসেছে। তার মুখে অস্বস্তির ছাপ। তিনি বললেন, ‘আমি তো শুধু অর্ডার পালন করেছি, কিন্তু আমার নামও চলে এলো।’ সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ‘কিছু খাবেন কিনা? কফি খাওয়াই?’ ক্লান্ত লাগছিল, তাই আমি আর না করলাম না। সে নিজের হাতে ধোঁয়া ওঠা কফি বানিয়ে আনলো। সে ভালো কফি বানাতে পারে সেটা স্বীকার করতেই হবে।
এরপর দেখলাম একের পর এক আশরাফুলের কাছে তার ঊর্ধ্বতন থেকে কল আসছে। আমাকে দ্রুত ছাড়ার তাগিদ দিচ্ছে। তবে সেটা ফর্মালিটি মেনে মুচলেকা লিখে আমার স্বাক্ষর করে এরপর ছাড়তে হবে। এই মুচলেকা রেডি করতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগলো। একবার মুচলেকায় একটা লাইন যোগ করতে বলে তো আবার পরের কলে সেটা ফেলে দিতে বলে। এভাবে অনেক সময় নিয়ে মুচলেকা রেডি করলো। আমাকে আটকের সময় কোনো স্থানীয় থানাকে জানানো বা আইডি কার্ড প্রদর্শনের যে বিধান রয়েছে, তার কোনোটিই মানা হয়নি। কিন্তু আমাকে ছাড়ার সময় ফর্মালিটি মানতে দুটি মুচলেকায় (একটি আমার, অন্যটি জিম্মাদারের) বাধ্যতামূলক স্বাক্ষর করতে হয়েছে।
এবার গাড়ি দরকার। কিন্তু গাড়ি চাওয়ার পরেও আশরাফুল ঠিক মতো সাপোর্ট পাচ্ছে না। দেরিও হয়ে যাচ্ছে। পরে সে ডিবি প্রধানকে ফোন করে বললে তাৎক্ষণিক বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা হয়। এরপর দ্রুত কালো গ্লাসের গাড়ি রেডি হলো। আমি যদিও এখান থেকে নিজে থেকেই বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাইরে অনেক সাংবাদিক দাঁড়িয়েছিলেন বলে সেই রিস্ক তারা নিতে চায়নি। খুব তাড়াহুড়ো করে আমাকে গেট থেকে বের করা হয়। আমার বন্ধু তানভীর খন্দকার ও সাবেক সহকর্মী শুভ সারারাত গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল, তাদের সাথে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। সাড়ে ১০ ঘণ্টার এই রুদ্ধশ্বাস জার্নিতে আমার পেটে পড়েছিল শুধুই পানি, চীনা বাদাম আর এক কাপ কফি। বাকি গল্প না হয় আরেকদিন হবে। ডিবিতে ভাতের হোটেল বন্ধ হয়েছে কি না জানি না, তবে আমার কপালে জুটেছিল এটুকুই!
লেখক: অনলাইন প্রধান, দৈনিক ভোরের কাগজ