২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর বিতর্কিত অভিজ্ঞতার পর মানুষের মনে নতুন আশার আলো—এবার কি ফেরত আসবে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে নির্বাচনের মাঠে দাঁড়ানো হাজারো কর্মকর্তার কর্মতৎপরতায়। প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং টিম ও রিটার্নিং অফিসারদের নিরপেক্ষতা থেকেই নির্ধারিত হবে গণতন্ত্রের পরবর্তী অধ্যায়।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের বিতর্কিত শাসনকাল শেষে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের উত্তেজনায়। ২০১৪ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখনো এ দেশের মানুষের স্মৃতিতে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। সেই অবিশ্বাসের জগদ্দল পাথর সরিয়ে এবার নতুন ভোরের প্রত্যাশা জেগেছে সবার মনে। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও সর্বোপরি সাধারণ ভোটাররা আশা করছেন, এবারের নির্বাচন হবে সত্যিকারের অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক।
কিন্তু একটি নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার মূল কারিগর কারা? ঢাকায় বসে থাকা নির্বাচন কমিশন, নাকি রাজপথে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো? বাস্তবে একটি সফল নির্বাচনের আসল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন নীরবে কাজ করে যাওয়া কয়েক লাখ কর্মকর্তা, যারা নির্বাচনের দিন হয়ে ওঠেন জনগণের ভোটের একমাত্র রক্ষাকর্তা। তাদের সততা, নির্ভীকতা আর দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে একটি আসনের ভাগ্য, আর সব আসন মিলিয়ে জাতির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ।
ভোটযুদ্ধে মাঠের কারিগর: কারা এই কর্মকর্তারা
নির্বাচন কোনো একক দিনের উৎসব নয়। বরং বিশাল কর্মযজ্ঞ, যার পেছনে রয়েছে সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো। এই কাঠামোর শীর্ষে থাকে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তাদের নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেন বিশাল বাহিনী, যারা মূলত সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী। স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা নির্বাচনের কয়েক দিনের জন্য তাদের মূল দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে হয়ে ওঠেন নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি।
এই কর্মকর্তাদের বিন্যাস পিরামিডের মতো। প্রতিটি জেলার জন্য থাকেন একজন রিটার্নিং অফিসার ও তাকে সহায়তার জন্য থাকেন এক বা একাধিক সহকারী রিটার্নিং অফিসার। তাদের অধীনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য থাকেন একজন প্রিসাইডিং অফিসার, যাকে কেন্দ্র পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাকে সাহায্য করার জন্য থাকেন একাধিক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও প্রতিটি ভোটকক্ষের (বুথ) জন্য থাকেন নির্দিষ্ট সংখ্যক পোলিং অফিসার। নির্বাচনের দিন এই কর্মকর্তারাই হয়ে ওঠেন নির্বাচন কমিশনের বিশ্বস্ত হাত, চোখ ও কান।
কেন্দ্রের অধিপতি: প্রিসাইডিং অফিসারের ক্ষমতা ও দায়বদ্ধতা
নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্রের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন প্রিসাইডিং অফিসার। তার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে কেন্দ্রের শত শত, এমনকি হাজার হাজার ভোটের ভাগ্য। আইন তাকে যে বিপুল ক্ষমতা দিয়েছে, তার সঠিক প্রয়োগই সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত। তাকে সহায়তার জন্য এক বা একাধিক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার থাকেন, যারা মূলত তার নির্দেশনায় বিভিন্ন বুথের কার্যক্রম তদারকি করেন ও তার অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিন্যাস পিরামিডের মতো
ভোটের আগের দিন থেকেই প্রিসাইডিং অফিসারের আসল যুদ্ধ শুরু হয়। রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে তিনি বুঝে নেন ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম—স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, সিলগালা করা ব্যালট পেপার, ভোটার তালিকা, অমোচনীয় কালির কলম, বিভিন্ন ধরনের সিল ও আরও অনেক কিছু। এরপর তিনি তার দল নিয়ে কেন্দ্রে উপস্থিত হন ও ভোটগ্রহণের জন্য কেন্দ্রটিকে প্রস্তুত করেন। বুথ তৈরি করা, ভোটারদের প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ নির্দিষ্ট করা ও কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা—সবই তার দায়িত্বে থাকে।
ভোটের দিন সকালে প্রিসাইডিং অফিসারের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, সকল প্রার্থীর এজেন্টদের উপস্থিতিতে খালি ব্যালট বাক্সটি দেখিয়ে সেটিকে তালাবদ্ধ ও সিলগালা করা। এই কাজই নিশ্চিত করে যে, ভোট শুরু হচ্ছে শূন্য থেকে। এরপর পুরোটা দিন প্রিসাইডিং অফিসারকে একযোগে বহু দায়িত্ব পালন করতে হয়। কেন্দ্রের ভেতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ভোটারদের পরিচয় শনাক্ত করা, জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা প্রতিহত করা ও কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া—সবই তাকে করতে হয়।
প্রিসাইডিং অফিসারের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হলো, ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা। যদি কেন্দ্রে কোনো ধরনের সহিংসতা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বুথ দখল বা বড় ধরনের অনিয়ম ঘটে, তবে প্রিসাইডিং অফিসার সাময়িকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে সেই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দিতে পারেন। তার এই সিদ্ধান্ত ও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনই পরবর্তী সময়ে সেই কেন্দ্রের ভাগ্য নির্ধারণ করে।
ভোটগ্রহণ শেষে আবারও সকল এজেন্টদের সামনে ব্যালট বাক্স খুলে ভোট গণনা করা ও ফলাফল শিট তৈরি করা তার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। প্রতিটি ব্যালটের হিসাব মিলিয়ে, বৈধ ও বাতিল ভোট আলাদা করে, প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট গণনা করে প্রিসাইডিং অফিসার যে ফলাফল শিট তৈরি করেন, সেটিই জনগণের রায়ের প্রথম আনুষ্ঠানিক দলিল।
সবশেষে, গণনা করা ব্যালট, মুড়িপত্র, ফলাফল শিট ও অন্যান্য সমস্ত সরঞ্জাম আলাদা আলাদা ব্যাগে সিলগালা করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মধ্য দিয়েই তার মহাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটে।
ভোটকক্ষের সম্মুখযোদ্ধা: পোলিং অফিসারের ভূমিকা
প্রিসাইডিং অফিসার যদি হন কেন্দ্রের অধিনায়ক, তবে পোলিং অফিসাররা হলেন ভোটকক্ষের সম্মুখযোদ্ধা। তারাই সরাসরি ভোটারদের মুখোমুখি হন ও ভোট প্রদানের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। প্রতিটি ভোটকক্ষে সাধারণত দুজন পোলিং অফিসার থাকেন, যাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করা থাকে।
প্রথম পোলিং অফিসারের কাছে থাকে ভোটার তালিকা। ভোটার যখন ভোটকক্ষে প্রবেশ করেন, তখন তিনি তার নাম ও ভোটার নম্বর মিলিয়ে দেখেন এবং ভোটার তালিকায় চিহ্ন দেন। এরপর তিনি ভোটারের আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ লাগিয়ে দেন, যাতে একই ব্যক্তি আবার ভোট দিতে না পারে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর পোলিং অফিসার ভোটারকে দ্বিতীয় পোলিং অফিসারের কাছে পাঠান।
দ্বিতীয় পোলিং অফিসারের দায়িত্বে থাকে ব্যালট পেপার। তিনি প্রথম পোলিং অফিসারের কাছ থেকে সংকেত পেয়ে ব্যালট পেপারের মুড়িপত্রে ভোটারের আঙুলের ছাপ নেন। এরপর ব্যালট পেপারের পেছনে সরকারি সিল মেরে সেটি ভোটারের হাতে তুলে দেন। এই পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়, যাতে কোনো ভুল না হয় ও প্রতিটি ব্যালটের সঠিক হিসাব থাকে। পোলিং অফিসাররাই নিশ্চিত করেন, একজন বৈধ ভোটার যেন নির্বিঘ্নে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
রিটার্নিং অফিসারের বিশাল কর্মযজ্ঞ ও সাম্প্রতিক বিতর্ক
প্রিসাইডিং অফিসার যদি হন একটি কেন্দ্রের অধিনায়ক, তবে রিটার্নিং অফিসার হলেন পুরো আসনের প্রধান সেনাপতি। তার কর্মযজ্ঞের পরিধি আরও অনেক বিশাল। একটি সংসদীয় আসনে কয়েকশ ভোটকেন্দ্র থাকতে পারে, আর সেই সব কেন্দ্রের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব থাকে একজন রিটার্নিং অফিসারের ওপর। তাকে এই বিশাল দায়িত্ব পালনে সহায়তা করার জন্য এক বা একাধিক সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে সম্প্রতি এই রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ নিয়েই বাংলাদেশে নতুন বিতর্ক দানা বেঁধেছে। ঐতিহ্যগতভাবে, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা দাবি তুলেছেন, জেলা প্রশাসকরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন, যা সরাসরি সরকারের নির্বাহী বিভাগের অংশ। ফলে, তাদের পক্ষে পুরোপুরি নিরপেক্ষ থাকা কঠিন ও তারা সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। এই অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই আসন্ন নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের দাবি জোরালো হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে এই বিতর্ক নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর গভীর উদ্বেগেরই প্রতিফলন।
সাধারণভাবে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রিটার্নিং অফিসারের কাজ শুরু হয়। তিনি তার নির্বাচনী এলাকার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ, সেগুলোকে আইন অনুযায়ী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করা ও বৈধ বা অবৈধ ঘোষণা করা তার অন্যতম প্রধান ক্ষমতা। এখানেই তিনি প্রথম নির্বাচনী আইন প্রয়োগের সুযোগ পান। এরপর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া ও চূড়ান্ত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করাও তার দায়িত্ব।
ভোটের দিন রিটার্নিং অফিসার পুরো আসনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। কোনো কেন্দ্রে বড় ধরনের গোলযোগের খবর পেলে তিনি সেই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করার নির্দেশ দিতে পারেন।
ভোটগ্রহণ শেষে তার দপ্তরেই প্রতিটি কেন্দ্র থেকে প্রিসাইডিং অফিসাররা ভোটের ফলাফল ও সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হন। তার তত্ত্বাবধানেই প্রতিটি কেন্দ্রের ফলাফলকে একত্রিত করে পুরো আসনের চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করা হয়। সকল কেন্দ্রের ফলাফল যোগ করে তিনি বেসরকারিভাবে বিজয়ী প্রার্থীকে ঘোষণা করেন ও এরপরই সেই চূড়ান্ত ফলাফল নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেন। তার এই ঘোষণার মাধ্যমেই একটি আসনের জনগণের রায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়।
পনেরো বছরের অবিশ্বাসের পর বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, তখন এই প্রিসাইডিং ও রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকা হয়ে উঠেছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেবে, নির্বাচন কমিশন নির্দেশনা জারি করবে, কিন্তু ভোটের দিন জনগণের রায়কে সুরক্ষিত রাখার শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি থাকবে এই মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাতেই।
তাদের সততা, নিরপেক্ষতা ও অকুতোভয় মানসিকতাই হতে পারে অবাধ নির্বাচনের মূল রক্ষাকবচ। ব্যালট বাক্সের এই অতন্দ্র প্রহরীরা যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন, তবেই হয়তো বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করতে পারবে।
তথ্যসূত্র: নির্বাচন কমিশন ও বিবিসি